বাজার অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। এখানে ক্রেতা-বিক্রেতা, চাহিদা-জোগান, দাম নির্ধারণ, প্রতিযোগিতা—সবকিছু সমাজের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই ইসলাম বাজারব্যবস্থাকে স্বাধীন রাখলেও তা নৈতিকতার সীমার মধ্যে রাখার ওপর জোর দেয়।
১. সততা ও আমানতদারি—বাজারে আস্থা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি : সততা বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টি করে।
যখন ব্যবসায়ীরা আমানতদার হন, তখন বাজারে ভেজাল, প্রতারণা বা কৃত্রিম সংকট তৈরি হয় না। এতে বাজার স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে—যা ইসলামী বাজার ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ীরা (কিয়ামতের দিন) নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২০৯)
২. ইবাদতকে অগ্রাধিকার দেওয়া—বাজারে নৈতিক নিয়ন্ত্রণের উপায় : যে সমাজে ব্যবসায়ী ইবাদতপরায়ণ, সে সমাজে অর্থের লোভে অনৈতিক কাজ কমে যায়।
এর ফলে বাজারে নৈতিক ভারসাম্য বজায় থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সেসব লোক যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং নামাজ কায়েম ও জাকাত প্র্রদান থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেদিনকে যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩৭)
৩. নিষিদ্ধ পণ্যের কারবার বর্জন—বাজারে পবিত্রতা রক্ষা করে : হারাম পণ্যের প্রচলন রোধ করলেই সমাজ ও রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে কল্যাণের পথে এগিয়ে যায়।
এটি বাজারকে পবিত্র রাখার মৌলিক শর্ত। আবু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) কুকুরের মূল্য, ব্যভিচারের বিনিময়, গণকের বখশিশ ভোগ করতে নিষেধ করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ২১২২; মুসলিম, হাদিস : ১৫৬৭)
৪. মিথ্যা শপথ ও প্রতারণা বর্জন—বাজারে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে : যখন ব্যবসায়ী মিথ্যা শপথ, মিথ্যা দাম বা গোপন ত্রুটি ব্যবহার করে বিক্রি করে, তখন বাজারে ন্যায়বিচার বিনষ্ট হয়। ইসলাম এই অন্যায় দূর করে ন্যায়নিষ্ঠ প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছ লেনদেন নিশ্চিত করতে চায়। আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন না।
বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি। নবী (সা.) এভাবে তিনবার বললেন। আবু জার (রা.) বলে উঠলেন, তারা তো ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। তারা কারা, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বলেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, অনুগ্রহ করে খোটা দানকারী এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়কারী।’ (মুসলিম, হাদিস : ১০৬)
৫. সঠিক পরিমাপ—বাজারে মান ও আস্থার নিয়ন্ত্রণ করে : মাপে বা ওজনে কম দেওয়া বাজারের বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস করে। ইসলামী দৃষ্টিতে এটি সমাজে অর্থনৈতিক শোষণ। তাই সঠিক পরিমাপ নিশ্চিত করা বাজারে মান নিয়ন্ত্রণের ইসলামী নীতি। আল্লাহ বলেন, ‘মন্দ পরিণাম তাদের যারা মাপে কম দেয়। যারা লোকের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পুরো মাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য মাপে তখন কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৩)
৬. মজুদদারি বর্জন—বাজারের স্বাভাবিক চাহিদা-জোগান রক্ষা করে : ইসলামী অর্থনীতিতে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যকে সম্মান করা হয়। কৃত্রিম সংকট তৈরি করা বা দাম বাড়ানোর জন্য মজুদদারি করা অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। নবী এটিকে মহামারি ও দারিদ্র্যের কারণ বলেছেন। অর্থাৎ এটি বাজারের স্থিতিশীলতা ধ্বংস করে। উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, আল্লাহ তায়ালা তার ওপর মহামারি ও দরিদ্রতা চাপিয়ে দেয়।’ (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ২১৫৫)
৭. হস্তগত হওয়ার আগে বিক্রয় না করা— বাজারে ঝুঁকি হ্রাস করে : যে ব্যক্তি নিজের দখলে না থাকা পণ্য বিক্রি করে, সে বাজারে অনিশ্চয়তা (uncertainty) ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ইসলামী নীতি অনুযায়ী মালিকানা ও দায় নিশ্চিত না করে বিক্রি করা বাজার ঝুঁকির (market risk) কারণ হয়। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি খাদ্যশস্য ক্রয় করলে সে যেন তা হস্তগত করার আগে বিক্রি না করে।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২৯)
৮. অনিশ্চিত পণ্য বিক্রি বর্জন—বাজারে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা দেয় : ইসলামী বাজারব্যবস্থা অনিশ্চয়তামূলক লেনদেন নিষিদ্ধ করে। এটি বাজারে স্বচ্ছতা ও পারস্পরিক আস্থা বজায় রাখে, যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) গবাদি পশুর গর্ভস্থ বাচ্চা প্রসবের আগে, পশুর স্তনের দুধ পরিমাপ না করে, পলাতক দাস, গনিমতের মাল বণ্টনের আগে, দান-খয়রাত হাতে আসার আগে এবং ডুবুরির বাজির (ডুব দিয়ে যা পাবে) ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ২১৯৬)
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডি প্রতিদিন/কেএ