মহানবী (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি দিক সাহাবায়ে কিরাম (রা.) ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সংরক্ষণ করেছেন। সোনালি যুগে খলিফারা সিরাত সংকলনের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। তাঁর চলাফেরা, কথাবার্তা, দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড, এমনকি হাসিকান্নাও তাঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন। এভাবেই গড়ে উঠেছে হাদিসশাস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার।
আর সেই ভাণ্ডার থেকে আলাদা হয়ে গড়ে ওঠে সিরাতশাস্ত্র, যেখানে নবীজির পূর্ণাঙ্গ জীবনচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। প্রথম দিকে যুদ্ধবিগ্রহ ও অভিযানের বিবরণ বেশি গুরুত্ব পায়। কিন্তু ধীরে ধীরে নবীজি (সা.)-এর জীবনচিত্র বিস্তৃত হয়ে মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শ ও পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে।
বাংলায় অমুসলিমদের সিরাত রচনার ইতিবৃত্ত
বাংলা ভাষায় সিরাত সাহিত্য মূলত মুসলিম লেখকদের কলমেই প্রসার লাভ করেছে।
তবে ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ে অমুসলিম পণ্ডিত ও সাহিত্যিকরাও নবীজীবনী রচনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের কেউ কৌতূহল, কেউ সাহিত্যচর্চার অংশ হিসেবে, আবার কেউ মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সিরাত রচনায় মনোযোগ দিয়েছেন। বিশেষত উনিশ শতকের বাংলায় ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন, পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তার এবং মিশনারি কার্যক্রম সাহিত্যচর্চায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এ সময়ে বহু হিন্দু, ব্রাহ্মণ ও অমুসলিম পণ্ডিত ইসলামের ইতিহাস, আল-কোরআনের অনুবাদ ও নবীজির (সা.)-এর জীবনচরিত রচনা করেন।
তাঁদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকলেও তা সিরাত সাহিত্যের বিকাশে অবদান রেখেছে।
উনিশ শতকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মিশনারিরা মহানবী (সা.)-এর জীবনী প্রকাশ করেছিল খ্রিস্টধর্মের প্রচারপত্রে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া। তারা মহানবী (সা.)-এর জীবনী রচনায় প্রতারণার আশ্রয় নেয়। তবে এই সময় কয়েকজন হিন্দু লেখক, বিশেষত ব্রাহ্মসমাজের লেখকরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব তৈরি ও ইসলাম সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা প্রচারের উদ্দেশ্যে কলম ধরেন।
তাঁদের মধ্যে গিরিশচন্দ্র সেন, কৃষ্ণকুমার মিত্র, অতুলকৃষ্ণ মিত্র এবং রামপ্রাণ গুপ্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক রামমোহন নিজেও মহানবীর জীবনী লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। রাজনারায়ণ বসু তো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন বলে ঘোষণাও দিয়েছিলেন। এ সময় শশিভূষণ মুখোপাধ্যায় ‘মুসলমান পত্রিকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। রামপ্রাণ গুপ্তের ‘হজরত মোহাম্মদ’ গ্রন্থটিও ধারাবাহিক প্রকাশ করে কেদারনাথ মজুমদারের ‘আরতি’ পত্রিকা। তখন তা বাংলা প্রেসিডেন্সি ও আসাম প্রদেশের ডিরেক্টর বাহাদুর কর্তৃক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার হিসেবে বিতরণ করা হয়।
বাংলায় অমুসলিমদের রচিত সিরাত গ্রন্থ
অমুসলিম লেখকদের রচিত কয়েকটি সিরাত গ্রন্থের বর্ণনা দেওয়া হলো—
১. রামাই পণ্ডিত : একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বৌদ্ধ কবি রামাই পণ্ডিত তাঁর ‘শূন্যপুরাণ’ গ্রন্থের ‘কলিমা জাল্লাল’ শীর্ষক কবিতায় মহানবী (সা.)-এর প্রশংসা করেছেন। তাঁর কবিতায় নবীজির নাম ও মাহাত্ম্য সপ্রশংসভাবে উঠে আসে। সেই কবিতার শুরুর দিকের কয়েকটি পঙক্তি এমন—
ওলন্তের মাল পড়িছে বিহান/ কাটিছেন খনকার তির কামান/ সুরৎ ঘোড়াকা পিষ্ঠে জিন পালান/ বার দিয়া বসিলেন খোদায় পরমান/ উচ্চালন্তি কাগজ বিচারন্তি পোথা/ আদি জনম খনকার হইল কোথা/ মারিয়া দুশমন কা সির/ বাদশা দিলেন মাহমূদ বির/ কে হিদূ কে মছলমান।
তাঁর এই কবিতা প্রমাণ করে, প্রাচীন বাংলার সাহিত্যেও অমুসলিম কবিদের কলমে মহানবী (সা.)-এর স্মৃতি স্থান পেয়েছিল।
২. শ্রীরামপুর মিশন : শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে এরপর ১৮০২ সালে এক খ্রিস্টান লেখকের রচিত ‘মহম্মদের বিবরণ’ নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। যদিও এর ভেতর ছিল ইসলামবিদ্বেষ ও অপপ্রচারের ছাপ, তবু বাংলা ভাষায় নবীজি (সা.)-এর জীবনকথা প্রথমবারের মতো মুদ্রিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল এই বই দিয়েই।
বিকৃতরূপে হলেও এর দ্বারাই সূচিত হয় সিরাতচর্চার এক নতুন অধ্যায়।
৩. গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) : ব্রাহ্মসমাজভুক্ত গিরিশচন্দ্র সেন বাংলা ভাষায় প্রথম কোরআনের অনুবাদ করেন (১৮৮৬ খ্রি.)। পাশাপাশি ‘মহাপুরুষ মুহাম্মদের জীবনচরিত’ নামে নবীজি (সা.)-এর জীবনীও রচনা করেন। তাঁর এই গ্রন্থ সিরাত-সাহিত্যের এক বৈপ্লবিক ধাপ। তাতে শুধু মহানবী (সা.)-এর দাওয়াতি জীবন নয়, বরং তাঁর সর্বজনীন আদর্শও চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। নবীজি (সা.)-এর জীবনী ছাড়াও তিনি ‘মহাপুরুষ দাউদের জীবনচরিত’, ‘মহাপুরুষ মুসার জীবনচরিত’, ‘মহাপুরুষ এব্রাহিমের জীবনচরিত’ নামে আরো তিনজন নবীর জীবনী লিখেছেন। এ ছাড়া বাংলা ভাষায় ইসলামের চার খলিফা, নবীজি (সা.)-এর নাতি হাসান-হুসাইন (রা.) এবং উম্মুল মুমিনিন খাদিজা, আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) নবীকন্যা ফাতিমা (রা.)-এর প্রথম জীবনী রচনা করেন তিনি। সব মিলিয়ে তিনি ৪২টি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
৪. কৃষ্ণকুমার মিত্র (১৮৫২-১৯৩৬) : ব্রাহ্মসমাজের প্রভাবশালী চিন্তক কৃষ্ণকুমার মিত্র ১৮৮৩ সালে ‘মহম্মদচরিত ও মুসলমান ধর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ’ নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটি অমুসলিম কর্তৃক রচিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সিরাতগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। এখানে তিনি নবীজি (সা.)-এর চরিত্র, নেতৃত্ব ও সামাজিক সংস্কারের দিকগুলো বিশদভাবে আলোচনায় এনেছেন। যদিও তাঁর লেখনীতে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব স্পষ্ট, তবু এই গ্রন্থ বাংলা সিরাত সাহিত্যের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।
৫. শ্রী রামপ্রাণ গুপ্ত (১৮৬৯-১৯২৭) : রামপ্রাণ গুপ্ত একজন বাঙালি লেখক, সমাজসেবী ও ইতিহাসবিদ। ১৯০৪ সালে তিনি ‘হজরত মুহাম্মদ’ নামে মহানবীর একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। এতে তিনি ধর্মীয় সংকীর্ণতা অতিক্রম করে মহানবীকে একজন সংস্কারক, নেতা ও মানবতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর লেখার ভঙ্গি ছিল তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ এবং মুসলিমসমাজেও তা গ্রহণযোগ্যতা পায়।
রামপ্রাণ গুপ্ত নবীজীবনী রচনার উদ্দেশ্য হিসেবে লিখেছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি এবং মুহাম্মদ (সা.)-কে সবার জন্য অনুকরণীয় করে তোলা। বইয়ের উৎসর্গপত্রে তিনি লেখেন, ‘বঙ্গীয় মোসলেম ভ্রাতৃবৃন্দকে এই গ্রন্থ সদ্ভাবের নিদর্শনস্বরূপ উপহার প্রদান করিলাম।’
৬. অতুলকৃষ্ণ মিত্র (১৮৫৭-১৯১২) : অতুলকৃষ্ণ মিত্র ছিলেন লেখক, সম্পাদক ও নাট্যকার। ১৮৯২ সালে তিনি ‘ধর্মবীর মুহাম্মদ’ নামের একটি নাটক রচনা করেন। যদিও মঞ্চে তা উপস্থাপিত হয়নি, তবে সাহিত্যরূপে এটি নবীজীবনের একটি অভিনব উপস্থাপনা।
নাট্যরূপে সিরাতচর্চা বাংলা সাহিত্যে অনন্য অবদান হিসেবে বিবেচিত হয়।
৭. গুরুদত্ত সিং : ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ প্রেম, বিস্ময়, শ্রদ্ধা ও আলোর ছোঁয়ায় ভরা একটি অসাধারণ সাহিত্যকর্ম। ভারতীয় শিখ লেখক গুরুদত্ত সিং নবীজি (সা.)-কে এমন হৃদয়ছোঁয়া ভাষায় উপস্থাপন করেছেন, যা ধর্ম ও সংস্কৃতির সীমা অতিক্রম করে পাঠকের অন্তর স্পর্শ করে। বইটি উর্দু ভাষায় ‘রাসুলে আরাবি’ নামে রচিত হলেও বাংলাদেশে এটি বেশ জনপ্রিয়। সুসাহিত্যিক ও আরবিবিদ মাওলানা আবু তাহের মেছবাহ এটি অনুবাদ করেছেন। গ্রন্থটিতে শুধু নবীজীবনী নয়, বরং একজন অমুসলিমের হৃদয়ে নবীপ্রেমের অনুপম প্রকাশ ঘটেছে।
সারকথা, বাংলা ভাষায় সিরাত সাহিত্য অমুসলিম লেখকদের প্রয়াস ছাড়া সমৃদ্ধ হতে পারত না। গিরিশচন্দ্র সেন, কৃষ্ণকুমার মিত্র, রামপ্রাণ গুপ্ত, অতুলকৃষ্ণ মিত্রের মতো পণ্ডিতরা তাঁদের রচনায় নবীজিকে (সা.) শুধু ধর্মীয় ব্যক্তি হিসেবে নয়; বরং মানবতা, ন্যায়পরায়ণতা ও সম্প্রীতির প্রতিমূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
তাঁদের এই প্রয়াস আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্য, সৌন্দর্য এবং মানবিক মূল্যবোধ কখনোই কোনো ধর্ম বা বিশ্বাসের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। ভাষা ও ভালোবাসা হতে পারে এমন এক শক্তিশালী সেতুবন্ধ, যা বিভেদ ও সীমারেখাকে অতিক্রম করে মানবতার ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন