মহাগ্রন্থ আল কোরআন। ইসলামের মূল তত্ত্ব ও তথ্যের প্রধান উৎস এই পবিত্র গ্রন্থ। পবিত্র কোরআনের বাণী বিশ্বজনীন, সর্বজনীন, চিরন্তন ও শাশ্বত। মানবতার উৎকর্ষ সাধনে ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে এর অবদান অতুলনীয়, মানুষের সার্বিক উন্নতি ও প্রকৃত সফলতার কালজয়ী পাথেয়। কোরআন অবমাননার প্রবণতা বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নামধারী মুসলমানরাও কথার ছলে রসিকতা ও জোকারি করতে গিয়ে এসব অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। কোরআনে কারিমে উল্লিখিত একটি শব্দ ‘রায়িনা’, অপর একটি শব্দ ‘উনযুরনা’ দুটি শব্দের অর্থ আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন। আভিধানিকভাবে শব্দ দুটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। বিজাতীয় পরিভাষা অনুযায়ী প্রথম শব্দটি একধরনের তিরস্কার। আল্লাহতায়ালা জানিয়ে দিলেন যেহেতু এই শব্দটি তিরস্কার ও অপমান করার লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয় তাই এই শব্দ নবীর শানে বর্জন করতে হবে। অতএব যে শব্দ বা বাক্য পরিভাষাগতভাবে আল্লাহতায়ালা, রসুলুল্লাহ (সা.) এবং কোরআনে কারিম ও ওলামায়ে কেরামের শানে অবমাননাকর হয়, তা অবশ্যই বর্জন করতে হবে।
ইসলাম মানুষকে চিন্তা-গবেষণা ও অনুসন্ধানের স্বাধীনতা দিয়েছে। মতপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে। দিয়েছে অধিকার রক্ষা করা ও সম্মান প্রদর্শন এবং শিষ্টাচারের বিধান। স্বাধীনতা ও দায়িত্ববোধের পরিপূরক ভারসাম্যপূর্ণ সীমারেখা রয়েছে এই ধর্মে। স্বাধীনতার নামে অপমান ও অসম্মান এই ধর্ম সমর্থন করে না। ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি, হিংসাবিদ্বেষের অনুমোদন এই ধর্মে নেই। অন্য কোনো ধর্ম, ধর্মীয় গ্রন্থ এবং ধর্মীয় পুরোধাকে অবমাননা করার অনুমতি এই ধর্ম প্রদান করে না। ইসলাম সবার প্রতি শান্তি, সহনশীলতা, ন্যায়বিচার, মানবিক ও সদাচরণের শিক্ষা দেয়। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করো সর্বোত্তম পন্থায়।’ (সুরা আন নাহল-১২৫)
অপর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদের ইবাদত করে তোমরা তাদের গালি দিও না, কারণ তারা অজ্ঞতাবশত সীমা লঙ্ঘন করে আল্লাহকেও গালি দেবে।’ (সুরা আল আনআম-১০৮)।
ইসলাম শুধু মুসলমানদের ধর্ম নয়। সব মানবজাতির জন্য এর দ্বার উন্মুক্ত আছে। তাই ইসলাম সব ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ ও তাদের অনুসারীদের প্রতি সামাজিক শিষ্টাচার রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম ধর্মের প্রতি আহ্বান করার ক্ষেত্রেও এই শিষ্টাচার গুরুত্বসহকারে পালন করার নির্দেশনা মুসলমানদের প্রতি রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনার প্রভুর পথে আহ্বান করুন সুকৌশলে ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে।’ (সুরা আন নাহল-১২৫)
ইসলাম একটি নৈতিক দর্শন। বিশ্বের দুই শতাধিক দেশে আজ ইসলামের অনুসারী রয়েছে। কোনো মুসলমান কর্তৃক অপর কোনো ধর্মগ্রন্থ বা ধর্ম সম্পর্কে বাড়াবাড়ি, অবমাননা ও শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণের ঘটনা অতি বিরল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কোরআন অবমাননা, ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে কটূক্তি এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এবং ইসলাম ও মুসলমানদের ঘৃণার প্রতীকে পরিণত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধর্মের লোকজন ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কথাবার্তা, বিদ্বেষজনক আচরণ লাগামহীনভাবে অব্যাহত রেখেছে। ফলে পৃথিবীব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে ধর্মীয় হানাহানি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বর্তমানে নীতিনৈতিকতা হারিয়ে কলুষতার অন্ধকারে ডুবে গেছে। সুশিক্ষার পরিবর্তে ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় পোশাক এবং ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে কটূক্তি ও নোংরামি আচরণ কতিপয় শিক্ষকের নিত্যদিনের অপকর্মে পরিণত হচ্ছে।
এসব ঘটনায় কে জড়িত, কী এর রহস্য? চিন্তাশীল জনগণকে এ বিষয়ে ভাবনার সময় এসেছে। সময় এসেছে এই হিংসাত্মক চক্রান্ত প্রতিহত করার। অনেক সময় প্রচার হয়, ঘটনাটি পরিকল্পিত। কিন্তু কখনো উদ্ঘাটন হয় না, কে সেই পরিকল্পনাকারী, কী এই পরিকল্পনার রহস্য? ইসলামের আলোকে যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে তাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। চলমান পরিস্থিতিতে ইসলামি বিধান বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
আমার ধারণামতে, ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব, নৈতিক অবক্ষয় এবং মানবতার শিক্ষা থেকে বিচ্যুতির ফলে একটি কুচক্রী মহল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদত দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম আল্লাহপ্রদত্ত সঠিক ধর্ম। কিয়ামত পর্যন্ত আগত মুসলমানদের মুক্তির দিশারি। এই ধর্মের অগ্রযাত্রায় কিছু হিংসুকের গতিরোধের চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, ইসলাম অবমাননায় ক্ষতি ইসলামের নয়। বরং তাদেরই, যারা অজ্ঞতার অন্ধকারে আটকে আছে। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘তারা তাদের মুখের ফুঁ দিয়ে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর আলো পূর্ণতা দান করবেন, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’ (সুরা আস সাফ-৮)
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা