জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে একমত হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ করা ৩০টি রাজনৈতিক দল। তবে বিতর্ক রয়ে গেছে গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে। মোটা দাগে এ নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত দলগুলো। একটি অংশ চায় জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট, আরেক অংশ নির্বাচনের আগে। এ নিয়ে নানান মত ও পথের যুক্তি দেখিয়েছে সংশ্লিষ্ট দলগুলো। এ বিতর্কের মধ্যেই ১৭ অক্টোবর জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু এখন নতুন বিতর্ক দেখা দিয়েছে গণভোটের আইনি ভিত্তি নিয়ে। সংবিধানের কোন বিধানের ভিত্তিতে হবে গণভোট তার পথ খুঁজছে কমিশন।
বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে কমিশন নির্ধারিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। কিন্তু সেখানে সমাধানের পথ পাওয়া যায়নি। এ ইস্যু নিয়ে আলোচনা এখনো চলমান। আবার কমিশনের সঙ্গে হওয়া সংলাপের সময় বেশ কয়েকটি দল বিষয়টি নিয়ে তাদের মতামত জানায়। কমিশন সেসব মতামত গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয় বিশ্লেষণ করছে। আইনি দিক খতিয়ে দেখছে।
এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর একটি সাংবিধানিক আদেশ জারি এবং পরবর্তীতে গণভোটের মাধ্যমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর সাংবিধানিক বিধানগুলো কার্যকরের প্রস্তাব করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন তাদের আইনি প্যানেলের সুপারিশের কথা উল্লেখ করে বলে, আইনি বিশেষজ্ঞদের প্যানেল প্রস্তাব করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার গণ অভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে একটি ‘সাংবিধানিক আদেশ’ জারি করতে পারে, যেখানে জুলাই সনদে উল্লিখিত মৌলিক সংস্কারগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ আদেশ তাৎক্ষণিক কার্যকর হবে। এরপর সেই সাংবিধানিক আদেশের ওপর গণভোট হতে পারে, যা অনুষ্ঠিত হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনই। সাংবিধানিক আদেশে গণভোটের বিধানও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যদি গণভোটে জনগণের অনুমোদন পাওয়া যায়, তাহলে সাংবিধানিক আদেশ জারির তারিখ থেকে সেটা বৈধতা পাবে। কমিশনের ওই প্রস্তাবের পর বিতর্ক দেখা যায় গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে। এ নিয়ে দলগুলো একমত না হতে পেরে দায়িত্ব দেয় কমিশন ও সরকারের ওপর।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো চায় নির্বাচনের দিনে গণভোট। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল চায় নির্বাচনের আগে গণভোট। বিএনপি আদেশ জারির বিরুদ্ধে। দলটির অবস্থান, বিদ্যমান আইনে হবে গণভোট। জামায়াত, এনসিপি আদেশের মাধ্যমে সনদের আইনি ভিত্তি চাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের পর কমিশন এখন পথ খুঁজছে গণভোটের সুনির্দিষ্ট আইনি ভিত্তির। পাশাপাশি গণভোটের সময় কখন ও গণভোটের প্রশ্ন কী হবে, তা নিয়েও সমাধানে পৌঁছাতে চায় কমিশন। গণভোট পরিচালনার জন্য আলাদা একটি আইন বা অধ্যাদেশ প্রয়োজন হবে কি না, তা নিয়েও পর্যালোচনা চলছে। সনদ বাস্তবায়নে যে আদেশ জারি করা হবে তার নাম কী হবে, এখনো ঠিক হয়নি।
ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, সনদ বাস্তবায়নের আদেশে গণভোটের প্রশ্ন থাকবে। গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে কমিশনের দুটি চিন্তা আছে। একটি হলো পুরো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চান কি না, এ প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়া। আরেকটি হলো যেসব প্রস্তাবে ভিন্নমত আছে, শুধু সেগুলোর বাস্তবায়ন চান কি না, এ প্রশ্নে গণভোট দেওয়া। কারণ যেসব প্রস্তাবে মতভিন্নতা নেই, সেগুলো বাস্তবায়নে তেমন সমস্যা হবে না। জটিলতা তৈরি হবে যেসব প্রস্তাবে ভিন্নমত আছে, সেগুলো বাস্তবায়নে।
এসব প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর এখন আমরা বাস্তবায়নের পথের দিকে এগোচ্ছি। বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আশা করি কমিশন তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পাবে। এ নিয়ে দলগুলোর পক্ষ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। প্রত্যাশা করি সামনের দিনগুলোতেও পাব।’
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ আদেশের ভিত্তি কী হবে, এ আদেশে কী থাকবে-এসব নির্ধারণে কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এটি নিয়ে গত রবিবার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছে কমিশন। তবে ওই আদেশে কী থাকবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করে আদেশের একটি খসড়া শিগগির কমিশনের কাছে উপস্থাপন করবেন বলে ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারিত না হওয়ায় সনদে সই করেনি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির নতুন দাবি, আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতি নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান আদেশ জারি করবেন। সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে সরকার আদেশ জারি করতে পারে এমন নজির পাওয়া যায়নি। তবে অভ্যুত্থানে জনগণের কর্তৃত্ববলে গঠিত সরকার আদেশ জারি করতে পারে, এমন মত দিয়েছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। এ ছাড়া বামধারার চারটি দলও এখনো সনদে সই করেনি। বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে এ মাসের মধ্যে সরকারকে সুপারিশ দেবে ঐকমত্য কমিশন।
চূড়ান্ত জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাতটি অঙ্গীকার করার শর্ত রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করার অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে দলগুলোর কাছ থেকে। সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন না করার শর্ত রয়েছে। চূড়ান্ত সনদে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়টা দল একমত, একমত নয়, মতামত দেয়নি ও নোট অব ডিসেন্ট সংযুক্ত করা হয়েছে। সনদে বিদ্যমান সংবিধানে থাকা চার মূলনীতি বাদ দেওয়া হয়েছে। উচ্চকক্ষে রাখা হয়েছে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।