ইসলামের সুরম্য প্রাসাদ যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর নির্মিত তার মধ্যে অন্যতম হলো জাকাত। এটি ইসলামী সমাজ ও অর্থ ব্যবস্থার অন্যতম চালিকাশক্তি। কোরআনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৮২ বার জাকাতের নির্দেশনা রয়েছে। এর দ্বারা জাকাত আদায়ের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।
‘জাকাত’ শব্দ দ্বারা ৩০ বার, ‘ইনফাক’ দ্বারা ৪৩ বার এবং ‘সাদাকাত’ দ্বারা ৯ বার এই জাকাতের নির্দেশনা রয়েছে। আল-কোরআনের ১৯টি সুরায় জাকাতের আলোচনা আছে। ইসলামে সালাতের বিধান দেওয়া হয়েছে আত্মার পবিত্রতার জন্য আর জাকাতের বিধান দেওয়া হয়েছে সম্পদকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার জন্য।
‘জাকাত’ বলতে ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ দান করাকে বোঝায়। পারিভাষিক অর্থে জাকাত বলতে সাহেবে নিসাবের ধন-সম্পদ, জমির ফসল ও খনিজ সম্পদের ওপর শরিয়ত নির্ধারিত অবশ্য দেয় সেই অংশকে বোঝায়, যা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের নিয়তে, ঈমানের সত্যতার প্রমাণস্বরূপ সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা অর্জন এবং সম্পদের ক্রমবৃদ্ধি সাধনের আশায় আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত আটটি খাতে ব্যয়-বণ্টন করার জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট তহবিলে জমা দেওয়া হয়। শরিয়তে মুসলিমদের জমিতে উৎপাদিত ফসলের জাকাতকে বলা হয়েছে ওশর। একে ফল ও ফসলের জাকাতও বলা হয়ে থাকে। ওশর মানে ১০ ভাগের এক ভাগ।
জাকাত কোনো দান বা করুণার বিষয় নয়। এটা ধনীদের সম্পদে মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত দরিদ্র জনগণের অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। জাকাত ইসলামী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠান। জাকাত দরিদ্র, অভাবী, অসহায় ও অক্ষম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার যেমন গ্যারান্টি, তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধির হাতিয়ার।
জাকাত শুধু মহানবী (সা.)-এর সময়ই ফরজ ছিল না, মানব সৃষ্টির পর থেকে সব সমাজে জাকাতের বিধান কার্যকর ছিল। তবে তার প্রক্রিয়া ছিল ভিন্ন ধরনের। তার কারণ জাকাত ছাড়া সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ, মমত্ববোধ যেমন তৈরি হতে পারে না, তেমনি সমাজের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানও হতে পারে না।
আমরা লক্ষ করি, আল্লাহ তাআলা নবী ইবরাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুব (আ)-এর ওপর জাকাতের বিধান দিয়ে বলেন, ‘আমি তাদের ইমাম করেছি, তারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করত। তাদের ওহি প্রেরণ করেছিলাম সৎকর্ম করতে, সালাত কায়েম করতে এবং জাকাত প্রদান করতে। তারা আমারই ইবাদত করত।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৭৩)।
বনি ইসরাঈলিদের কথা উল্লেখ করে অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি, যদি তোমরা সালাত কায়েম করো, জাকাত দাও।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১২)।
আল্লাহ ঈসা (আ.)-এর প্রসঙ্গে বলেন, ‘সে বলল, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যত দিন জীবিত থাকি তত দিন সালাত ও জাকাত আদায় করতে।’ (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ৩১)।
কোরআন ও হাদিসের আলোকে জাকাত
মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় জাকাত সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছেন।
সুরা বাকারার ১১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত প্রদান করো।’
একই সুরার ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত আদায় করো আর বিনয়ীদের সঙ্গে বিনয় প্রকাশ করো।’
সুরা বাইয়্যিনার ৫ নম্বর আয়াতে জাকাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এবং তোমাদের এই আদেশ দেওয়া হয়েছে যে তারা বিশুদ্ধচিত্তে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে, জাকাত দেবে আর এটাই সঠিক দ্বিন।’
সুরা তাওবার ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তবে তারা যদি তাওবা করে, নামাজ কায়েম করে ও জাকাত দেয়, তবে তারা তোমাদের দ্বিনি ভাই।’
জাকাত সম্পর্কে রাসুল কারিম (সা.) বলেন, ‘আমি আদিষ্ট হয়েছি এ জন্য যে আমি যুদ্ধ করব লোকদের সঙ্গে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেবে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল এবং নামাজ কায়েম করবে ও জাকাত দেবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫)।
জাকাত না দেওয়ার পরিণতি সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে জাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথাবিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় মালা পরিয়ে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪০৩)।
জাকাতের আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব
জাকাত গরিবের হক হিসেবে আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। জাকাত ইসলামী অর্থব্যবস্থার অন্যতম উৎস। জাকাত এ জন্য ফরজ করা হয়েছে, যেন সম্পদ শুধু ধনীদের হাতে পুঞ্জীভূত না থাকে, বরং কিছু সম্পদ অভাবী, অসহায় ও দরিদ্র লোকদের কাছেও হস্তান্তরিত হয়। এতে সমাজে বেকারত্বও কমে যায়। এভাবে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণে জাকাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মানুষ অভাবে থাকলে বা ক্ষুধার্ত থাকলে তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। সে যেকোনো উপায়ে তার জীবনধারণের চেষ্টা করে। ফলে তার মধ্যে ধর্ম-অধর্ম কোনো জ্ঞান থাকে না। ক্ষুধার্ত বা অভাবী মানুষ যেকোনো অপরাধ করতে কাপর্ণ্য করে না। একসময় সে কুফরির দিকে ধাবিত হয়। তাই মহানবী (সা.) দরিদ্রতা ও কুফরি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। দারিদ্র্য মানুষের চিন্তাশক্তিকে বিলুপ্ত করে। এ জন্য ইমাম আবু হানিফা (রা) বলেন, যার বাড়িতে আটা নেই, তার নিকট কোনো পরামর্শ দিতে যেয়ো না। কারণ তার চিন্তা বিক্ষুব্ধ হতে বাধ্য।
জাকাতের আর্থ-সামাজিক গুরুত্বের কিছু বিষয় নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
ক. জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে : সালাত যেমন মানুষের আত্মাকে পবিত্র করে, তেমনি জাকাত তার ধন-সম্পদকে পবিত্র এবং অকল্যাণমুক্ত করে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা (জাকাত) গ্রহণ করুন, এর মাধ্যমে আপনি তাদের পবিত্র করবেন।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০৩)।
মহানবী (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জাকাত প্রদান করবে, তার সম্পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূর হয়ে যায়।’ (তারবানি, হাদিস : ১৬০৮)।
খ. জাকাত দারিদ্র্য দূর করে : সুরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা জাকাতের আটটি খাতের উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে চারটি খাত হলো : ফকির, মিসকিন, দাস-দাসী এবং ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। এই চারটি শ্রেণির মানুষ হচ্ছে অবহেলিত, পীড়িত ও অভাবগ্রস্ত। জাকাত এদের মধ্যে বণ্টিত হলে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হতে বাধ্য, যা সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করে সমাজকে করে আর্থিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ।
আমরা এক পরিসংখ্যান থেকে জানতে পারি, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০.৫ শতাংশ লোক দরিদ্র এবং সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশ। আর মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ লোক জাকাত দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। এই হিসাবে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা জাকাত আদায় হওয়ার কথা। যদি শরয়ি আইন ও নীতি মেনে জাকাত আদায় ও বিতরণ করা হয়, তাহলে ২০.৫ শতাংশ লোকের দরিদ্র থাকার কথা নয়।
গ. জাকাত উৎপাদন বৃদ্ধি করে : অর্থনীতিতে জাকাতের প্রভাব খুবই উল্লেখযোগ্য। জাকাত গরিব, দুঃখী ও অভাবী মানুষের মধ্যে যথাযথভাবে বণ্টিত হলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে এসব লোকের চাহিদা বাড়ে। চাহিদা পূরণের জন্য স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন ও জোগান বৃদ্ধি পায়। এতে বাজারে চাহিদা বাড়ে। চাহিদা বাড়ার কারণে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর সঙ্গে মুনাফাও বেড়ে যায়। এভাবে জাকাত অর্থনীতিতে সঞ্চারিত গতি হয়। ফলে সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেড়ে যায়।
ঘ. জাকাত অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে : জাকাত ঠিকমতো আদায় ও বিলি-বণ্টন হলে গরিব ও অভাবীরা সচ্ছল ও উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ পায়। ফলে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূরীভূত হয়। জাকাত ধনীদের সম্পদকে গরিবদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এর ফলে সম্পদ কেবল ধনীদের হাতেই আটকে থাকে না। মানুষের মধ্যে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করার জন্য আল্লাহ তাআলা সুরা হাশরের ৭ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন, ‘সম্পদ যেন কেবল তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়।’
ঙ. জাকাত সমাজে শান্তি আনয়ন করে : জাকাত প্রদানের মাধ্যমে অর্থনীতির যে ভীত তৈর হয় তাতে ধনী-গরিবের বৈষম্য কমে যায়। সমাজের বিরাট হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে সম্পদ বণ্টিত হওয়ার ফলে সমাজে থাকে না কোনো বিরোধ। এতে জাকাত দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সহমর্মিতা ও সদ্ভাবের সম্পর্ক তৈরি হয়। পারস্পরিক ভালোবাসায় সবাই সিক্ত হয়। এতে সমাজে ফিরে আসে শান্তি ও নিরাপত্তা।
দারিদ্র্য বিমোচন ও জাকাত
জাকাতের বহুমুখী অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, বিশেষ করে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও তার অভাব-অনটন দূর করার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে জাকাতের ভূমিকা অনন্য। ইসলাম সমাজের অনাহারী, অভুক্ত ও অবহেলিত মানুষের চাহিদা পূরণে গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকি এসব শ্রেণির চাহিদার অবহেলার পরিণতি সম্পর্কে ইসলামে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।
আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সে প্রকৃত মুসলমান নয়, যে তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজের উদরপূর্তি করে।’
ইসলামের এই যে বিধান এবং মানুষের কাছে অর্থনৈতিক সহায়তা পৌঁছে দিয়ে তাকে স্বাবলম্বী ও কর্মক্ষম করে তোলা, তার অনন্য কর্মকৌশল হলো জাকাতব্যবস্থা।
অতএব, ইসলামের বনিয়াদি নীতির স্বার্থে, দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির লক্ষ্যে এবং সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে সমপদশালী মুসলমানের উচিত সুষ্ঠুভাবে জাকাত আদায় করা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাবেক অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, স্ট্যান্ডার্ড (ইসলামী) ব্যাংক।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ