গত মঙ্গলবার হঠাৎ করে কাতারের রাজধানী দোহায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। সেখানে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এই হামলায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র চার মাস আগে কাতারের আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সে সময় দোহার ঝলমলে প্রাসাদে তাকে বিমুগ্ধ দেখা যায়। তখন উপসাগরীয় এই মিত্রের সঙ্গে এক বিস্তৃত প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেন ট্রাম্প। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেয় কাতার। মূলত এখান থেকেই ইরাকের প্রয়াত নেতা সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে হামলা চালানো হয়। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে সামরিক তৎপরতা তা এই ঘাঁটিকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু দোহায় মঙ্গলবারের ইসরায়েলি বিমান হামলার সেই সম্পর্ককে নাড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনায় দৃশ্যত ক্ষুব্ধ হন ট্রাম্প। দোহা ও পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকেও তীব্র নিন্দার ঝড় উঠেছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নির্দেশে চালানো এই হামলায় ফিলিস্তিনি সংগঠনের রাজনৈতিক কার্যালয়কে টার্গেট করা হয়। এতে এক কাতারি নিরাপত্তাকর্মীসহ ছয়জন নিহত হলেও হামাস নেতারা বেঁচে যান।
ট্রাম্প বলেন, তিনি এ হামলার ‘প্রত্যেক দিক নিয়েই অত্যন্ত অসন্তুষ্ট’। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা ও বিশ্লেষকদের মতে, এই ক্ষোভের পরও ট্রাম্পের ইসরায়েল নীতিতে বড় কোনও পরিবর্তন আসছে না। বরং হামলাটি ট্রাম্প-নেতানিয়াহু সম্পর্কের শীতল হিসাব-নিকাশকেই স্পষ্ট করেছে। এই সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করে এমনটাই লিখেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
মার্কিন কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ইসরায়েল দেখিয়েছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে তোয়াক্কা না করেই পদক্ষেপ নিতে পারে। মঙ্গলবারের অভিযানের আগে ওয়াশিংটনকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও সতর্কবার্তা দেয়নি নেতানিয়াহু প্রশাসন।
এর আগে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের হামলার ঘটনাও অনুরূপ ছিল। তখন হাজারো যোদ্ধাকে ফাঁদ পাতা পেজারের মাধ্যমে জখম করেছিল তারা, অথচ তখনকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে কিছুই জানানো হয়নি। ট্রাম্পও মাঝে মাঝে নেতানিয়াহুর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে তার প্রশাসন হামাসকে দুর্বল করার ইসরায়েলি অভিযানের প্রতি জোরালো সমর্থন দিয়েছে এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে মূলত ইসরায়েলকেই নেতৃত্ব নিতে দিয়েছে।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো ও সাবেক মার্কিন শান্তি আলোচক অ্যারন ডেভিড মিলার বলেন, এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর কৌশল নিয়ে বিরক্ত। তবে তার স্বভাবতই ধারণা হলো- হামাসকে শুধু সামরিকভাবে খোলস ছাড়ানো যথেষ্ট নয়, একে মূল থেকে দুর্বল করতে হবে।
হোয়াইট হাউস এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে এবং ট্রাম্পের ট্রুথ সোশ্যালে মঙ্গলবার রাতের পোস্টের প্রতি ইঙ্গিত দেয়। সেখানে ট্রাম্প লিখেছেন, হামলা যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের স্বার্থ অগ্রসর করেনি। তবে, হামাসকে নির্মূল করা- যারা গাজার মানুষের দুর্দশা থেকে লাভবান হয়েছে, তা একটি যথার্থ লক্ষ্য।
ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি দূতাবাস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
কিছু বিশ্লেষক অবশ্য বলছেন, যদি নেতানিয়াহু আবার হঠাৎ ওয়াশিংটনকে অন্ধকারে রেখে অভিযান চালায়, তবে ট্রাম্পের ধৈর্য ফুরিয়ে যেতে পারে। বাস্তবে এর মানে হতে পারে গাজার চলমান আক্রমণে ইসরায়েলের জন্য রাজনৈতিক আড়াল প্রত্যাহার করে নেওয়া- যা ইউরোপ ও আরব দেশগুলোতে ক্ষোভ ছড়াচ্ছে, বিশেষ করে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে।
গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরু হয় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। মার্কিন সাবেক কূটনীতিক ডেনিস রস বলেন, আরব মিত্ররা এখন ইসরায়েলের কার্যক্রম নিয়ে ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করছে। তখন ট্রাম্প হয়তো বলবেন, আমাকে গাজার জন্য একটি বাস্তবসম্মত পরবর্তী পরিকল্পনা দাও- হামাস ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প প্রশাসন প্রস্তাব করো। তাহলে আমি নেতানিয়াহুকে বলব যথেষ্ট হয়েছে। তবে কাতার হামলার পর ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় আরব দেশগুলোকে আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে আনার আশায় ধাক্কা লাগতে পারে। তবুও, সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন ইসরায়েলের সাবেক যুক্তরাষ্ট্রদূত মাইকেল ওরেন। তার মতে, ট্রাম্প শক্তি ও যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে এমন লেনদেন- দুটোই পছন্দ করেন।
তিনি বলেন, নেতানিয়াহু যদি এ দুই দিকেই ট্রাম্পকে আকৃষ্ট করতে পারেন, তবে সম্পর্ক নিয়ে আমি চিন্তিত নই। ট্রাম্প-নেতানিয়াহু সম্পর্ক সবসময় ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে গেছে।
হোয়াইট হাউসের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, প্রচারণা থেকেই সম্পর্কটা গরম-ঠাণ্ডা চলছে। প্রথম বড় বিদেশ সফরে ট্রাম্প সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান। কিন্তু ইসরায়েল এড়িয়ে যান- যা অনেক বিশ্লেষকের কাছে ইসরায়েলের প্রতি এক ধরনের উপেক্ষা হিসেবে ধরা পড়ে। তবে জানুয়ারিতে পুনর্নির্বাচিত হয়ে তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। ওই সফরে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের চাপে ট্রাম্প সিরিয়ার নতুন সরকারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। এতে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হন, কারণ নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা ছিলেন একসময়ের আল-কায়েদা কমান্ডার। তবু এক মাসের মধ্যেই সম্পর্ক আবার ঘনিষ্ঠ হয়। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েল বিমান হামলা শুরু করলে ট্রাম্প বিস্ময়করভাবে বি-২ বোমারু পাঠিয়ে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো আংশিক ধ্বংস করেন। যদিও তিনি প্রচারণায় বিদেশি সংঘাত এড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এই পদক্ষেপ ট্রাম্পের কূটনীতিতে স্বল্পমেয়াদে উপকার আনেনি। কয়েকদিন পরই তিনি প্রকাশ্যে ইরান ও ইসরায়েলকে গালাগালি করেন যুক্তরাষ্ট্র-মধ্যস্থ অস্ত্রবিরতি ভাঙার জন্য।
জুলাই মাসে দামেস্কে ইসরায়েলি হামলা নিয়ে ওয়াশিংটনও প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানায়। মঙ্গলবার কাতারে হামলার আগে ইসরায়েল ওয়াশিংটনকে খুব অল্প সময়ের নোটিশ দিলেও কোনও সমন্বয় বা অনুমোদন নেয়নি, জানিয়েছেন দুই মার্কিন কর্মকর্তা।
মার্কিন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জনাথন প্যানিকফ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে উৎসাহিত বা চাপ দিতে পারে। কিন্তু নেতানিয়াহু এমনভাবেই কাজ চালিয়ে যাবেন, যা তিনি কেবল ইসরায়েলের স্বার্থেই সঠিক মনে করেন। সূত্র: রয়টার্স
বিডি প্রতিদিন/একেএ