ফিলিস্তিনি লেখক ও পশ্চিম এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক আবদুল্লাহ মারুফ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘বৃহৎ ইসরায়েল’-এর স্বপ্ন নিয়ে আরব দেশগুলোকে সতর্ক করেছেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি টেলিভিশন চ্যানেল আই২৪-এর উপস্থাপক শ্যারন গালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, ‘তিনি একটি ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক মিশনে আছেন এবং মানসিকভাবে ‘বৃহৎ ইসরায়েল’-এর স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত।’
পার্সটুডে জানিয়েছে, ফিলিস্তিনি লেখক ফিলিস্তিনি আবদুল্লাহ মারুফ বুধবার আল জাজিরা'র ওয়েবসাইটে লিখেছেন, এই মন্তব্যগুলো যে প্রেক্ষাপটে এসেছে, তা উপেক্ষা করা যাবে না। কারণ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী শ্যারন গাল একজন পরিচিত উপস্থাপক এবং ইসরায়েলের ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ইসরায়েল বেইতেনু–এর সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য, যা আভিগদোর লিবারম্যানের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।
সাক্ষাৎকারে শ্যারন গাল নেতানিয়াহুকে একটি মানচিত্র ‘উপহার’ দেন— যেখানে ‘নীল নদ থেকে ফোরাত’ পর্যন্ত অঞ্চলকে ‘বাইবেলীয় ইসরাইল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, তার দীর্ঘদিনের একটি ব্যক্তিগত স্বপ্নের প্রতীক— একটি ‘প্রতিশ্রুত ভূমির’ মানচিত্র। এসময় নেতানিয়াহুকে গাল জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কি এই দর্শনে বিশ্বাস করেন?’ নেতানিয়াহু দুইবার জোর দিয়ে উত্তর দেন, ‘পুরোপুরি’।
এ নিয়ে আবদুল্লাহ মারুফ বলেন, এই উপহার আসলে একটি লকেট বা তাবিজ, যা ইসরায়েলের চরমপন্থী ডানপন্থি সমর্থকরা বহন করে এবং যার ওপর খোদাই করা থাকে ‘বৃহৎ ইসরায়েল’ বা ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’র মানচিত্র—যা নীল নদ থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত বিস্তৃত।
লেখকের মতে, এই পরিস্থিতির দুটি সম্ভাবনা থাকতে পারে—
প্রথম সম্ভাবনা, নেতানিয়াহু ও গাল আগে থেকেই এই সাক্ষাৎকারের পরিকল্পনা করেছিলেন, যাতে নেতানিয়াহু তার নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে পারেন, তবে তা যেন উদ্দেশ্যমূলক মনে না হয়। এমন পদক্ষেপ নেতানিয়াহুর মতো রাজনীতিকের জন্য অস্বাভাবিক নয়, যিনি রাজনৈতিক চালচিত্রে পারদর্শী। এতে তিনি এমন একজন নেতার ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চাইতে পারেন, যিনি প্রথমবার সৎভাবে নিজের অন্তর্নিহিত বিশ্বাস প্রকাশ করছেন— যা চরমপন্থী ধর্মীয় ইহুদিবাদীদের সমর্থন পাওয়ার একটি উপায় হতে পারে, বিশেষ করে গাজায় তার হামলার প্রেক্ষাপটে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা, নেতানিয়াহু হয়তো সত্যিই এমন প্রশ্ন আশা করেননি এবং বাধ্য হয়েছিলেন দুটি ছবির মধ্যে একটি বেছে নিতে— একটি ধর্মনিরপেক্ষ ছবি, যা তার দল ও মন্ত্রিসভা বহন করে; অথবা একটি ধর্মীয়-তোরা-ভিত্তিক ছবি, যা আজ চরমপন্থী ধর্মীয় ইহুদিবাদী শিবিরে ক্রমশ উচ্চকণ্ঠ হচ্ছে।
মারুফের মতে, নেতানিয়াহু সাধারণত বিতর্কিত বিষয় যেমন ‘বৃহৎ ইসরায়েল’-এর স্বপ্ন বা অন্যান্য সংবেদনশীল বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য এড়িয়ে চলেন এবং মন্ত্রিসভার ধর্মীয় জায়নিস্ট সদস্য যেমন বেজালেল স্মোটরিচ বা ইতামার বেন-গভিরের কট্টর মন্তব্য থেকে নিজেকে দূরে রাখেন— যেখানে মসজিদুল আকসার নিয়ন্ত্রণ, পশ্চিম তীর দখল ও জর্ডান, লেবানন, মিশর ও সিরিয়ায় আধিপত্যের মতো প্রসঙ্গ উঠে আসে।
কিন্তু এবার শ্যারন গালের উপহারটি সরাসরি ‘বৃহৎ ইসরায়েল’-এর ধারণার সঙ্গে যুক্ত থাকায় নেতানিয়াহুর সামনে দুটি পথ ছিল— হয় রাজনৈতিক কৌশলে ধর্মনিরপেক্ষ ইসরায়েলের ভাবমূর্তি রক্ষা করা, যা বেন-গুরিয়ন যুগ থেকে জায়নিস্টদের কাছে গর্বের বিষয়; অথবা সুযোগটি কাজে লাগিয়ে সরাসরি ধর্মীয় জায়নিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থনের ঘোষণা দেওয়া।
তিনি দ্বিতীয় পথ বেছে নিলেন—এবং প্রকাশ্যে ধর্মীয় ইহুদিবাদীদের সমর্থন ঘোষণা করলেন, যা তোরা-ভিত্তিক মিথে প্রতিষ্ঠিত এবং তারা যা ইসরায়েলের ভবিষ্যতের ভিত্তি মনে করে।
নেতানিয়াহু জানতেন ‘বৃহৎ ইসরায়েল’ বা ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’র ধারণা এমন সব দেশের ভূখণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে, যাদের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তিচুক্তি বা সম্পর্ক রয়েছে—বিশেষ করে জর্ডান ও মিশর এবং এমনকি সৌদি আরবের অংশবিশেষ, যার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা তিনি একাধিকবার বলেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত আছে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকও। তাই এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ্য সমর্থন মানে হলো, ইসরায়েল পূর্ববর্তী আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসছে।
লেখক সতর্ক করেছেন, এখন অঞ্চলের আরব সরকারগুলোর উচিত নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে ইসরায়েলের নতুন ও আনুষ্ঠানিক নীতি হিসেবে গণ্য করা—যা আর শুধু স্মোটরিচ বা বেন-গভিরের মতো ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই অবস্থান প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর প্রতি সুস্পষ্ট শত্রুতার ইঙ্গিত, যা মোকাবেলায় শুধু রাজনৈতিক বিবৃতি বা নিন্দা যথেষ্ট নয়; বরং বাস্তব পদক্ষেপ প্রয়োজন।
তার মতে, সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ হলো—আরব ও ইসলামী ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্টের সামনে ইসরায়েলের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করা এবং যে ইস্যুটি এই সমীকরণ ভেঙে দিতে পারে তা হলো গাজার অবরোধ ভাঙা। কিন্তু আরব বিশ্ব যদি দ্রুত প্রতিক্রিয়া না দেখায়, এই সংকট আরও গভীর হবে।
সূত্র : পার্সটুডে।
বিডি-প্রতিদিন/শআ