উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের ভাগবাঁটোয়ারার সঙ্গে জড়িত বলে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব নিয়েও অভিযোগ করেন তিনি। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা জানান। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন, দলের উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ।
চলমান সংলাপের অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল সন্ধ্যায় জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এর আগে মঙ্গলবার তিনি বিএনপির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন।
কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বললে তাঁদের দুরভিসন্ধি রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা মনে করি, উপদেষ্টা পরিষদের নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করা লাগবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য। সে দাবির সঙ্গে ভিন্নমত নেই। কিন্তু এই উপদেষ্টা পরিষদ পুরো পরিবর্তন করতে হবে, এটার আসলে সুযোগ নেই।
নাহিদ বলেন, জুলাই সনদের শুধু কাগুজে মূল্যে আমরা বিশ্বাসী নই। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সেটির নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই আমরা সনদে স্বাক্ষর করব। তিনি আরও বলেন, প্রতীক না থাকলে আমরা কী নিয়ে নির্বাচন করব। ‘শাপলা’ ছাড়া অন্য কোনো প্রতীকে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব না।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ছাত্র উপদেষ্টারা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে নেই। তাঁরা অভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে অন্য উপদেষ্টারাও যেমন, ছাত্র উপদেষ্টারাও তেমনি। তিনি আরও বলেন, যদি ছাত্র উপদেষ্টাদের কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতিনিধি বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়, তবে অন্য উপদেষ্টাদের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। অনেকেরই পূর্বে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল। তাই এসব বিষয় সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। এনসিপি আহ্বায়ক জানান, সরকার যখন গঠিত হয়, তখন বিভিন্ন দলের রেফারেন্সে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। অনেকেই সেই সূত্রে এই সরকারের অংশ হয়েছেন। ফলে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টাদের নয়, সবার ক্ষেত্রেই বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি, কারা কোন দলের সঙ্গে যুক্ত বা প্রশাসনের ভাগবাঁটোয়ারায় জড়িত। এসব বিষয় সার্বিকভাবে বিবেচনা করতে হবে।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ বলেন, জনপ্রশাসনের যে বদলি হচ্ছে সেগুলো কীসের ভিত্তিতে হচ্ছে। সেগুলো দক্ষতা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে হচ্ছে কি না। আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং শুনতে পাচ্ছি যে, প্রশাসনের বিভিন্ন ভাগবাঁটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে যারা পরিচয় দেয় তারা প্রশাসন, এসপি, ডিসি ভাগবাঁটোয়ারা করছে। নির্বাচনের জন্য তারা তালিকা করছে এবং সেগুলো সরকারকে দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের ভিতর থেকেও সেই দলগুলোকে সহায়তা করা হচ্ছে। এভাবে চললে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। উপদেষ্টা পরিষদে যাদের বিরুদ্ধে এই সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদের বিষয় যেন প্রধান উপদেষ্টা সিদ্ধান্ত নেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়ে আমরা উদ্বেগ জানিয়েছি। নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন কমিশনের বর্তমান আচরণ আমাদের কাছে নিরপেক্ষ মনে হচ্ছে না, স্বচ্ছ হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম করার কথা ছিল, সেগুলো করছে না। নির্বাচন কমিশনে পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু দলের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ দেখা যাচ্ছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে দায় সরকারের ওপর আসবে। তাই এ বিষয়ে সরকারকে আমরা বলেছি। আমরা মনে করি, এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রয়োজন।
নাহিদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে আমরা অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি।
তার মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই গণহত্যার বিচারের বিষয়টি। আমরা আজ দেখেছি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং অভিযোগের কারণে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে আদালতে আনা হয়েছে। আমরা এটাকে সাধুবাদ জানিয়েছি। সরকার এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি আমরা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। ন্যায়বিচারের একটি ধাপ আমরা আগাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, এর পাশাপাশি সারা দেশে শহীদ এবং আহত পরিবারের পক্ষ থেকে যেসব মামলা হয়েছে, সেই মামলাগুলোর বিষয়ে সরকারের কী পদক্ষেপ, পত্রপত্রিকায় আমরা দেখতে পাচ্ছি জামিনে আসামিরা ছাড়া পাচ্ছে। শহীদ পরিবার এবং আহতদের হুমকি দিচ্ছে। শহীদ পরিবার, আহতদের নিরাপত্তা এবং বিচারের যে রোডম্যাপ আমরা চেয়েছি সেই রোডম্যাপ যেন প্রকাশ করা হয়। ৮০০-এর অধিক যে মামলাগুলো হয়েছে সে মামলাগুলোর এখন কি অবস্থা, সেগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে, কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হবে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা জুলাই সনদ নিয়ে কথা বলেছি। জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে এবং এনসিপি সেখানে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে আমরা আমাদের অবস্থান সরকারের কাছে তুলে ধরেছি। ঐকমত্য কমিশনের কাছেও আমরা তুলে ধরেছি। আমরা সেই কথাগুলোই পুনর্ব্যক্ত করেছি যে, জুলাই সনদের শুধু কাগুজে মূল্যে আমরা বিশ্বাসী নই। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সেটির নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই আমরা সনদে স্বাক্ষর করব।