১৯৭০ থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সব নির্বাচনেই প্রতিবেশী ভারতের কমবেশি প্রভাব ছিল। আগামী নির্বাচনেও অশুভ প্রভাব থাকার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দাদা চুপচাপ বসে থাকবেন, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ’৭০-এর নির্বাচনে ভারতীয় ব্যাপক প্রভাবের কারণেই নৌকার জয় হয়েছিল এবং যার ফলে ভেঙে যায় পাকিস্তান। পাকিস্তান ভেঙে জন্ম হয় বাংলাদেশের। কিন্তু বিজয় উল্লাস করে ভারত। পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের শতকরা ৯৯ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধ করেছে দেশের স্বাধীনতার জন্য। অন্যদিকে স্বাধীনতাকামী মানুষকে ভারত সহযোগিতা করেছে পাকিস্তান ভাঙার কৌশল হিসেবে। ভারতের সহযোগিতায় পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্মের পর প্রতিবেশীর প্রভাবমুক্ত হওয়া আমাদের জন্য কষ্টকর হয়। তার পরও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়া চেষ্টা করেছেন দেশকে ভারতীয় চাপমুক্ত রাখতে। তাঁরা কোনো কোনো ইস্যুতে সফল হলেও সব ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন এমন বলা যাবে না। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়া অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয়দের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সে কারণে একজন হয়েছেন নিহত, অন্যজনকে দীর্ঘ কারাবরণসহ নানান যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। ইতিহাসের ভিতর-বাইরের হিসাবনিকাশে দেখা যায় ২০০১, ২০০৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন ছিল পুরোপুরি ভারতীয় ডিজাইনে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর জরিপ অনুযায়ী, ২০২৪-এর নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে বিপুল ভোটে জয়লাভ করত। তখন বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়। আগামী নির্বাচনের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইনও প্রতিবেশী ইতোমধ্যে করে ফেলেছে। দেশীয় প্রকাশ্য ও গুপ্ত সঙ্গীদের নিয়ে প্রতিবেশীর এ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন হলো, যেভাবেই হোক বিএনপি ঠেকানো। জাতীয়তাবাদী আদর্শের সমর্থকরা বিষয়টি ইতোমধ্যে অনুধাবন করতে পেরেছেন; কিন্তু বিএনপির নেতা-কর্মীরা সেটা বুঝতে পারছেন বলে তাদের আচার-আচরণে এখনো স্পষ্ট হচ্ছে না।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অংশগ্রহণে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু শুভাকাক্সক্ষী ও তথাকথিত সমমনা মিত্রের চাপে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি জানতেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বিএনপিকে ৩০ আসন দেওয়া হবে। তার পরও মিত্রকে খুশি করতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এর পর থেকে ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিংয়েই এ দেশে নির্বাচন হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ‘র’ দেশের প্রতিটি আসন ধরে ধরে জরিপ চালায় এবং একটি তথ্যবহুল ডেটাবেস তৈরি করে। এতে গুরুত্বসহকারে ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন পরিস্থিতি, জনমতসহ যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত মূল্যায়ন করা হয়। জরিপে আগের দুই নির্বাচন কেমন ছিল তার ওপর ভিত্তি করেই ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে মাইনাস করার জন্য ষড়যন্ত্রের সবরকম জাল বোনা হয়। ওই জরিপে দেখা যায়, বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাহলে এককভাবে ১৬০টি আসন পায়। আর জোটবদ্ধভাবে পায় ১৮৪ আসন। এ জরিপের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা এবং ভারতীয় হাইকমিশন ও তাদের সাউথ ব্লকের মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা হয়। এরপর শুরু হয় নতুন খেলা। বিএনপি যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে সেজন্য কয়েক ধাপে বিস্তারিত একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন তৈরি করা হয়। কয়েকজন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, কিছু অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, বিএনপি ও সমমনা জোটের কিছু নেতাকে নিয়ে একটি প্রোপাগান্ডা সেল গঠন করা হয়। এ সেলের সদস্যরা নামে-বেনামে বিভিন্ন পত্রিকায় বিএনপির শুভাকাক্সক্ষী সেজে লেখালেখি শুরু করেন। তাদের লেখার মূল বিষয় ছিল, বিএনপি নির্বাচনে গেলে ভুল করবে। বেগম জিয়ার আপসহীন ইমেজ ক্ষুণ্ন হবে। বিএনপি অংশ নিলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে ওই সরকার বৈধতা পাবে। আর অংশ না নিলে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নতুন সরকারের পতন ঘটবে। অন্যদিকে বিএনপির কিছু নেতাকে একত্র করে পুনর্গঠন করা হয় ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ‘তৃণমূল বিএনপি’। টেলিভিশন টকশো ও পত্রপত্রিকায় লেখালেখিতে তখন বিএনপির শুভাকাক্সক্ষীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও বিএনপি নেতাদের ওপর প্রচণ্ড রকম চাপ সৃষ্টি হয়। সে চাপে বিএনপির ওপর কেমন প্রভাব পড়ছে, সে রিপোর্ট প্রায় প্রতিদিনই ‘র’-এর নেপাল অফিসে পাঠানো হতো। নেপাল থেকে সেই রিপোর্ট যেত নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকে। বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন রক্তিম (ছদ্মনাম) ‘র’ এবং এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে দেশীয় যারা জড়িত ছিলেন তাদের সমন্বয় করতেন। এ কাজের জন্য মোটা অঙ্কের বাজেট ছিল। তখন এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা যে যেভাবে পেরেছেন টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই সিন্ডিকেট নির্বাচনের আগে অনেক সেমিনারও করে। সেমিনারে সবার বক্তব্যই ছিল বিএনপির শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে। আর এসব কাজের লিয়াজোঁ সভাগুলো হতো গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে। শেষ পর্যন্ত এ ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি নির্বাচন না করার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই চক্র বিজয় উল্লাস করে। পরবর্তীতে ভারতের সাউথ ব্লক ও শেখ হাসিনা এ সিন্ডিকেটের সবাইকে নানাভাবে পুরস্কৃত করেছেন। ওই চক্রের একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। কয়েকজন এখন জেলখানায় এবং অন্যরা বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
বিএনপির বিরুদ্ধে এবারের ষড়যন্ত্র একটু ভিন্ন কৌশলে হচ্ছে। এবারের টার্গেটও বিএনপিকে মাইনাস করা। এর জন্য কৌশল হলো বিএনপির ভোট কয়েক ভাগে ভাগ করা। গতবারের কৌশল ছিল নির্বাচন থেকে বিএনপিকে দূরে রাখা। আর এবারের কৌশল নির্বাচনে পরাজিত করা। জানা গেছে, এবারের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএনপির বেশ কিছু নেতা-কর্মীকেই ব্যবহার করা হবে। এর জন্য ১০০ আসন চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এসব আসনে বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিত একাধিক ব্যক্তিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হবে। যেসব আসনে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রভাব রয়েছে, সেসব আসনে তাদের মধ্য থেকেও প্রার্থী দেওয়া হবে। ১০০ আসনে বিএনপির ভোট যদি তিন ভাগে ভাগ করা যায় তা হলেই তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং সফল হবে। এ প্রক্রিয়ায় একটি বিশেষ দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে প্রতিবেশী। এবার সংবাদপত্র বা টেলিভিশন টকশোকে অপপ্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হবে না। দেশবিদেশ থেকে নামে-বেনামে নানান সমাজমাধ্যমে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা করা হবে। আসনভিত্তিক বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে অপপ্রচারের বিভিন্ন কনটেন্ট ইতোমধ্যে তৈরির কাজ চলছে। শুধু একটি দলের সঙ্গে নয়, পশ্চিমা বেশ কিছু দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও প্রতিবেশীর গোয়েন্দা সংস্থা যোগাযোগ রাখছে। যেটা তারা করেছিল ওয়ান-ইলেভেন ও ২০০৮-এর নির্বাচন কেন্দ্র করে। এ ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি জরিপ হয়েছে। বিএনপির ভোট ভাগ করতে পারলে তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং সফলতা লাভ করবে বলে তারা মনে করছে।
বিএনপি মাইনাসের বিকল্প ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইনও প্রতিবেশী এবং তার গুপ্ত বন্ধুদের করা আছে। সেটা হলো নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র। বর্তমান সরকারের ভিতরে নানান জটিলতা সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ চাঙা করে নির্বাচন পেছানোর বিকল্প ফর্মুলাও আছে তাদের হাতে। সেই ফর্মুলার ইঙ্গিতই দিয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ইকবাল করিম ভূইয়া। তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া স্ট্যাটাসে আগামীতে কী হবে সে সম্পর্কে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার আরও এক-দুই বছর থাকবে। তারপর নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় আরোহণের সম্ভাবনা। বিএনপি পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারবে কি না তা নির্ভর করবে কিছুটা ভারতের কৌশলগত অবস্থানের ওপর এবং কিছুটা আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন ও শক্তি সঞ্চয়ের ওপর। যদি বিএনপি তার বিরুদ্ধে পরিচালিত পরিকল্পিত সহিংসতাবিরোধী আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হয়, তবে ওয়ান-ইলেভেনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। অদক্ষতা/আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে অথবা ছাত্র চাপের মুখে সংস্কার-মিশনে হাত দিলে নির্বাচন না হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকবে। তখন দুর্বল মন্ত্রীরা বদলাবে এবং ড. ইউনূসকে প্রেসিডেন্ট করে ঐকমত্যের জাতীয় সরকার গঠিত হবে। সংবিধান বদলের ক্ষীণ গুঞ্জন উচ্চকিত হলেও আগামী পাঁচ বছর যাবে গণপরিষদের নির্বাচন, সংবিধান প্রণয়ন ও গণভোটে। যা-ই ঘটুক, এ পাঁচটি বছর দেশবাসীকে বাস করতে হবে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা, প্রতিবাদ, আন্দোলন, হরতাল-অবরোধ, সহিংসতার ভিতর দিয়ে। পঙ্গু অর্থনীতি দরিদ্রদের আরও বিপদে ফেলবে এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ ক্রমাগত পেছাতে থাকবে।’ তার বক্তব্যে একমাত্র বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। আর অন্য সব বিষয় সম্পর্কে বক্তব্যে মনে হচ্ছে, তিনি যা বলছেন তা নিশ্চিত হবে। এমন আত্মবিশ্বাসী বক্তব্যকে সাদা চোখে মূল্যায়নের কিছু নেই। কারণ তিনি সাবেক সেনাপ্রধান। শেখ হাসিনার শাসনামলে জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূইয়া ২০১২ সালের ২৫ জুন দায়িত্ব গ্রহণ এবং ২০১৫ সালের ২৫ জুন অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের দিন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। সেখান থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাদের ভারতে আশ্রয় দেন। ভারত সরকার শুধু শেখ হাসিনাকে আশ্রয়ই দেয়নি, রাজনৈতিক শিক্ষাও দিয়েছে। তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে যখন দেশে ফেরেন, এর ঠিক ১৩ দিন পর অর্থাৎ ৩০ মে নিহত হন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পঁচাত্তরের ঠিক ৫০ বছর পর তিনি আবার ভারতের আশ্রয়ে আছেন। ভারত অতীতের মতো নিশ্চয় তাদের প্রিয় মানুষকে প্রস্তুত করছে। তিনি যদি আবার ফিরে আসেন তখন কোনো অঘটনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, এটা ভাবার কারণ নেই। সুতরাং ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে গুপ্ত পরকীয়া না করে ফ্যাসিবাদবিরোধী সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সবাইকেই মনে রাখতে হবে, পরকীয়ার পরিণতি ভালো হয় না। হয় সংসার ভাঙে, না হয় বদনাম রটে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন