জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জোট বাড়ছে বিএনপির। ইতোমধ্যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এবার বৃহৎ নির্বাচনি জোট গঠন করতে যাচ্ছে দলটি। বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। বিএনপির প্রতিও দিনদিন রাজনৈতিক দলগুলোর ভরসা ও আস্থা বাড়ছে। যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ও সমমনা দল ছাড়াও এর বাইরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আরও বেশ কিছু দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নেতৃত্বে একটি বৃহৎ জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এতে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে শরিক দল, জোট ছাড়াও যুগপতের বাইরে হাসিনা সরকারবিরোধী মনোভাবাপন্ন দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ও গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক যেসব দল নির্বাচনি জোটে আসতে চাইবে তাদের সবাইকেই এর অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আরেকটু অগ্রগতির পর সবকিছু জানানো হবে।
জানা যায়, জুলাই গণ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণতন্ত্র মঞ্চ ও সিপিবির নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোটও নির্বাচন সামনে রেখে নয়া মেরূকরণ করতে চায়। এদেরসহ আরও বিভিন্ন দল নিয়ে একটি বড় নির্বাচনি জোট গঠন করতে চায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটি এরই মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে যেসব জোট ও দল সম্পৃক্ত ছিল তাদের কাছে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা চাওয়ার পর তাদের বেশির ভাগের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে প্রত্যাশিত আসন ও প্রার্থী তালিকা বিএনপির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব দলের কিছু সম্ভাব্য প্রার্থীকে বিএনপি গ্রিন সিগন্যালও দিয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য দলের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করছে দলটি।
বিএনপির নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় তাঁদের দলের পক্ষ থেকে একটি বৃহৎ জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিল এমন সমমনা দল-জোটসহ অন্যান্য উদার গণতান্ত্রিক, ইসলামি ও আলেমদের সমন্বয়ে এ জোট গঠন করা হবে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির মিত্র দল ও জোট যথাক্রমে ছয় দলের সমন্বয়ে গঠিত গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২-দলীয় জোট, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণফোরাম, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি), লেবার পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ।
জানা গেছে, যুগপতের শরিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে বিএনপি। দলটির নেতৃত্বে যে বৃহৎ নির্বাচনি মোর্চা হতে যাচ্ছে, সেখানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য, গণফোরাম ও লেবার পার্টি থাকছে।
এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জোট গঠনে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে মাত্র। দেখা যাক সেটি কীভাবে গঠিত হয়। তবে আমরা বিএনপির সঙ্গে শুরু থেকেই আছি। তারা তালিকা চেয়েছে, আমরা তালিকা তৈরি করছি।’
১২-দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম। আগামী নির্বাচনেও একসঙ্গে অংশগ্রহণ করব। আমরা এরই মধ্যে বিএনপির আহ্বানে ৩০-৩৫টি আসনের একটি তালিকাও দিয়েছি।’ গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্বে যে নির্বাচনি জোট হতে যাচ্ছে, তাতে আমরা আছি। ইতোমধ্যে আমরা সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকাও জমা দিয়েছি।’ আগামী নির্বাচন ঘিরে যে মেরূকরণ হচ্ছে, তাতেও বিএনপির সঙ্গে তাঁর দল থাকবে বলে জানিয়েছেন এলডিপি প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। এলডিপি মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ বলেন, ২০১২ সাল থেকে তাঁর দল বিএনপির সঙ্গে আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের সাবেক সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিএনপির উদ্যোগে যে নির্বাচনি জোট হতে যাচ্ছে, তাতে তাঁরা থাকছেন। এরই মধ্যে তাঁদের জোট সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকাও জমা দিয়েছে বিএনপির কাছে।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, তাঁর দল বিএনপি জোটের সঙ্গে আছে। পার্থ ঢাকার একটি আসন (গুলশান) থেকে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের প্রধান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে আমাদের জোট ছিল। আগামীতেও যে কোনো মেরূকরণে বিএনপির সঙ্গে থাকব।’ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জানান, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যে জোট করতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তাঁর দল রয়েছে। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম। সামনে নির্বাচন। কোনো জোট নয়, তাদের সঙ্গে আমাদের আসন সমঝোতার আলোচনা অব্যাহত আছে।’ দেশের আলেম সমাজ ও তাদের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে পাশে চায় বিএনপি। এজন্য দলটির নেতারা ইতোমধ্যে হাটহাজারী মাদরাসা, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, ছারছিনার পীর, আলিয়া মাদরাসাধারার যেসব মুরুব্বি ও আলেম আছেন তাঁদের সঙ্গেও দেখা করেছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, এর উদ্দেশ্য একটাই-বাংলাদেশের সব জনগোষ্ঠীকে আমরা একত্র ও ঐক্যবদ্ধ করে এমনভাবে দেশ পরিচালনা করতে চাই, যেখানে বিভক্তি থাকবে না। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন বলেন, তফসিল ঘোষণার পরই আসন সমঝোতা বা নির্বাচনি জোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে তাঁদের দল। তিনি বলেন, ‘আমরা বিএনপির সঙ্গে ২০২২ সাল থেকে আছি। ২০২৪ সালে তো আমরা একসঙ্গে ফ্যাসিবাদ তাড়িয়েছি। আমরা ইতোমধ্যে ৫০টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছি।’ এদিকে বিএনপি তার জোটে আনার জন্য বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করছে। বিএনপির কয়েকজন নেতা অনানুষ্ঠানিকভাবে সিপিবির সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে সিপিবির নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন বলেন, ‘এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। আসলে কার সঙ্গে আমাদের নির্বাচনি ঐক্য হবে, তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।’ এ বিষয়ে এনসিপির অনেক নেতাই প্রাথমিকভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানা যায়। আগামী সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব রাখতে চায় এনসিপি। এনসিপির অন্য একটি অংশ জামায়াতের সঙ্গে এবং একটি অংশ বিকল্প হিসেবে নতুন একটি জোট করতে চায়। এর অংশ হিসেবে অতিসম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবের বাসায় গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপির নেতারা বৈঠক করেন। দুই মাস আগে এনসিপি নেতারা বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্মদিনে তাঁর বাসায় গিয়ে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছেন।