সরকারের প্রধান কাজ জনগণের সেবা প্রদান। কিন্তু একশ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারী জনগণকে সেবা প্রদানের বিনিময়ে করেন চাঁদাবাজি। কেউ ফাইল আটকে রেখে চাঁদা নেন কেউ দ্রুত কাজ করে দেওয়ার বিনিময়ে নেন উপরি। কেউবা সরকারি সেবার বিনিময়ে চাঁদা গ্রহণ করাটা বৈধ মনে করেন। বহুদিন ধরে সরকারি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব চাঁদাবাজি চলছে। ৫ আগস্টের পর সাধারণ মানুষ আশা করেছিল সরকারি অফিসে এসব হয়রানি থেকে তারা মুক্তি পাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জুলাই বিপ্লবের পর প্রাতিষ্ঠানিক চাঁদাবাজি অব্যাহত রয়েছে। টিআইবির গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে প্রধানত পাঁচটি সেবা নিতে জনগণকে চাঁদা বা অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হয়। এই সেবা খাতগুলো হলো-
১) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে থানায় সেবা গ্রহণের সময়। ২) ভূমি অফিসে সেবা গ্রহণের সময়। ৩) বিআরটিএ বা সড়ক পরিবহন সেবা গ্রহণের সময়। ৪) আদালতে আইনি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে। ৫) হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে। এ ছাড়াও পাসপোর্ট সেবা, জন্মনিবন্ধন সনদ, নাগরিক পরিচয়পত্র লাভসহ আরও অন্তত দশটি সেবা লাভের জন্য নাগরিকদের অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হয়।
পাঁচ আগস্টের পর সাধারণ মানুষ আশা করেছিল নাগরিক সেবা লাভের ক্ষেত্রে হয়রানি এবং চাঁদাবাজি কমবে। কিন্তু গত দেড় বছরে কোথাও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি বেড়েছে। থানায় সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার একজন ভুক্তভোগী এই প্রতিবেদককে জানান, তার দুর্ভাগ্যের কথা। তার কাছে চাঁদা দাবি করে একদল তরুণ। অফিসে গিয়ে হুমকি দিতে থাকে বারবার। একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে ভুক্তভোগী যান থানায়। থানা দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে চাঁদাবাজদের পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার পরামর্শ দেয়। একজন এসআই পর্যায়ের অফিসার বলেন- ‘এটা দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলুন। ভুক্তভোগী তো হতবাক। পুলিশ কোথায় চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে উল্টো তারাই চাঁদাবাজদের পক্ষে ওকালতি করছে। ওই ভুক্তভোগী জানান, পরে তিনি জানতে পেরেছেন পুলিশের সঙ্গে চাঁদাবাজদের গোপন আঁতাত আছে। শুধু এই ঘটনা নয়, গত দেড় বছরে থানাগুলোর বিরুদ্ধে মামলা বাণিজ্যের নামে চাঁদাবাজির বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। যাত্রাবাড়ী এলাকায় একজন ভুক্তভোগী জানান, চাঁদাবাজ এবং পুলিশ মিলে নিরীহ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দিয়ে চাঁদাবাজি করছে। তিনি তার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘গত জানুয়ারি মাসে কিছু তরুণ আমার প্রতিষ্ঠানে আসে। তারা আমার কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। আমাকে হুমকি দেয় চাঁদা না দিলে আগস্ট হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে। আমি পাত্তা দেইনি। কারণ আমি নিজেই জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। এলাকার লোকজন এটা জানেন। কিন্তু একসপ্তাহ পর যাত্রাবাড়ী থানা থেকে ফোন আসে। আমাকে বলা হয় আমি একটি হত্যা মামলার আসামি। তিনি ছেলেপেলেদের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন। পরে কী হয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে তাই বলতে চাননি। শুধু বলেন, এদেশে থাকতে হলে চাঁদা দিয়ে থাকতে হবে। এই একটি ঘটনা না, চাঁদাবাজির এমন ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন থানায়। পুলিশের মনোবল নেই, পুলিশ বাহিনী এখনো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি-এরকম কথা আমরা প্রতিদিন শুনছি কিন্তু বাস্তবতা হলো, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও চাঁদাবাজিতে কিছু পুলিশ বাহিনীর সদস্যের দক্ষতা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ভুয়া মামলায় নাম ঢুকিয়ে চাঁদাবাজি, গণ মামলার আসামিদের কাছ থেকে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির বহু অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে। ভূমি অফিসে চাঁদাবাজির রেট বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সাব রেজিস্ট্রারসহ ভূমি সংশ্লিষ্ট অফিসারদের পদায়ন খরচ বেড়ে গেছে। জেলা প্রশাসক পদায়নে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগে পুরোনো। সাব রেজিস্ট্রার পদায়নে ঘুষের রেট বেড়েছে। ফলশ্রুতিতে সেবা গ্রহণকারীদের ওপর চাঁদার পরিমাণ বেড়েছে। এখনি অবস্থা অন্যান্য সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও। গ্যাসের লাইন নিতে আগেও ঘুষ দিতে হতো, এখনো হয়। টেন্ডার বাণিজ্যে চাঁদাবাজি বেড়েছে। একজন ব্যবসায়ী বলছিলেন। আগে সরকারি টেন্ডারে একজনকে ঘুষ দিলেই হতো, এখন দিতে হয় ঘাটে ঘাটে।
ভুক্তভোগীরা বলেছেন সরকারের ভিতরেই চাঁদাবাজদের শক্ত অবস্থান। দালাল পক্ষ বদল করে এখনি নতুন বন্দোবস্তে হয়ে উঠেছে ক্ষমতাবান। এদের চাঁদাবাজি রুখবে কে?