অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে চরবিজয়। মানুষের খুব একটা বিচরণ না থাকায় শীতের শুরুতে কুয়াকাটাসংলগ্ন সমুদ্রের মধ্যে জেগে ওঠা এ দ্বীপটিতে নানান প্রজাতির রংবেরঙের পাখির আগমন ঘটছে। দেখলে মনে হবে পাখির মেলা বসেছে। এসব পাখি মেতেছে খুনসুটি আর জলকেলিতে। আবার কোনো পাখি বালুচরে ব্যস্ত রয়েছে খাবার সংগ্রহে। কোনো কোনো পাখি দলবেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। একই সঙ্গে এ দ্বীপটিতে রয়েছে লাল কাঁকড়ার অবাধ বিচরণ। এসব সৌন্দর্য উপভোগ করতে আগত পর্যটকরা প্রতিনিয়ত ছুটছে চরবিজয়ে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৫ হাজার একর আয়তন নিয়ে বঙ্গোপসাগরের বুক চিড়ে জেগে ওঠে এ দ্বীপটি। কুয়াকাটা সৈকত থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে এর অবস্থান। প্রতি বছরের মতো এবারও শীতের শুরুতে দ্বীপটিতে আশ্রয় নিয়েছে জুলফি পানচিল, গাংচিল, ধূসর মাথা টিটি, সিঁথি হাঁস, খুন্তে হাঁস, খয়রা চখাচখি, ছোট পানকৌড়ি, ছোট বগা, বড় বগা, পিয়ং হাঁস, ধূসর বগা, পাতিহাঁস, কালো মাথা গাংচিল, ছোট ধলাজিরিয়া, ছোট নর্থ জিরিয়া, গো বগা, মেটে রাজহাঁস, পাতিবাটান, চেগা, পাতিচেগাসহ নানান প্রজাতির পাখি। সুদূর সাইবেরিয়াসহ দূরদূরান্ত থেকে এসব অতিথি পাখি বছরের নভেম্বরের প্রথম দিকেই আসতে শুরু করে এবং মার্চ পর্যন্ত অবস্থান নেয় দ্বীপটিতে।
এদিকে এসব পাখি শিকারকে নিরুৎসাহ করতে মাঠে রয়েছে স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ও বন বিভাগ। ইতোমধ্যে ২০টি ঘুঘু ও বক শিকারের পর ফেসবুক লাইভে রান্না করে ভোজনের দায়ে এক যুবককে ১০ হাজার টাকা অর্থদ , অনাদায়ে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদ দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
স্থানীয় পর্যটন কর্মীরা জানান, দিগন্তজোড়া আকাশ আর সমুদ্রের নীল জলরাশি আছড়ে পড়ছে কিনারায়। জেগে ওঠা দ্বীপটির নাম ‘চরবিজয়’ রাখা হলেও গভীর সাগরে মাছ ধরা জেলেদের কাছে ‘হাইরের চর’ নামে পরিচিত। ইতোমধ্যে দ্বীপটিতে বন বিভাগ ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু ম্যানগ্রোভ প্রজাতির চারা গাছ রোপণ করা হয়েছে। মূলত ২০১৭ সাল থেকে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। এ চরের পাখি আর লাল কাঁকড়ার সমাগমে আকৃষ্ট হয় সব শ্রেণির পর্যটক। তবে চরবিজয় ভবিষ্যতে সেন্ট মার্টিনের মতো জনপ্রিয়তা পাবে বলে মনে করেন তারা।
দ্বীপটি ঘুরে এসে পর্যটকরা বলেন, চারদিকে সাগরের অথই পানি। এরই মধ্যে আকাশ আর মাটির সঙ্গে মিতালি তৈরি করেছে। এ যেন প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্য। নানান প্রজাতির রংবেরঙের পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত থাকে বিশাল এ দ্বীপটি। তবে সঠিক তদারকিতে তৈরি হবে একটি নতুন সমভূমি। যাকে ঘিরে কুয়াকাটার পর্যটনশিল্পে তৈরি হবে আরেক মাত্রা। এমন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন পর্যটকরা।
পর্যটক আরাফাত হোসাইন জানান, ‘কুয়াকাটায় এই প্রথমবার ভ্রমণে এসেছি। তবে সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা চরবিজয় সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। সব মিলিয়ে চরবিজয় দ্বীপটি অপার সম্ভাবনাময়।’
পর্যটক আহসান হাবিব জানান, ‘সত্যিকারে এ দ্বীপটি ঘুরে মুগ্ধ হয়েছি। চারদিকে বিশাল সমুদ্রের মাঝখানে একটি দ্বীপ। আর সেখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অতিথি পাখি ও লাল কাঁকড়া। তবে এ দ্বীপে পর্যাপ্ত গাছ লাগানো দরকার, যাতে পাখিদের নির্ভয় বাসস্থান তৈরি হয়।’
ট্যুরিজম ব্যবসায়ী মো. জনি আলমগীর বলেন, ‘কুয়াকাটা থেকে ট্যুরিস্ট বোটে যেতে লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। এ সময় পর্যটকরা উপভোগ করতে পারবেন সমুদ্রের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। বিস্তীর্ণ জলরাশি ও সমুদ্রের বিশালতা ভ্রমণে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। দ্বীপের কাছাকাছি গেলেই স্বাগত জানাবে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। আর স্বচ্ছ জলে সামুদ্রিক মাছের ছোটাছুটি নিমেষেই সারা দিনের ক্লান্ত মন ভরিয়ে দেবে অন্যরকম আনন্দে। তবে এ দ্বীপে নেই কোনো দোকানপাট, তাই খাবার, পানিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।’ সকালে গিয়ে বিকালেই ফিরে আসা হবে বলে তিনি জানান।
কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (কুটুম) সহসভাপতি হোসাইন আমির বলেন, ‘কুয়াকাটার কাছে চরবিজয় দ্বীপে শীতকালে শুরুতেই অতিথি পাখি আসতে শুরু করেছে। এ সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির লক্ষাধিক পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। এ দ্বীপটি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্ষা মৌসুমের ছয় মাস চরটি হাঁটুপানিতে ডুবে থাকে এবং শীত মৌসুমে ধু-ধু বালু নিয়ে জেগে ওঠে। এ সময়ে জেলেরা অস্থায়ী বাসা তৈরি করে মাছ শিকার এবং শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করেন।’ মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা এ কে এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বিস্তৃত দ্বীপটিতে রোপণ করা গাছগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। সুফল প্রকল্পের আওতায় বনায়নের কার্যক্রম চলছে। চরবিজয়ে বনায়ন তৈরি হলে অতিথি পাখির অভয়াশ্রম গড়ে উঠবে।’