ভূমিকম্পে ঝুঁকির প্রধান কারণ হিসেবে ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন তৈরি করাকে দায়ী করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসাইন ভুঁঞা। গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। অধ্যাপক আনোয়ার হোসাইন ভুঁঞা বলেন, আমরা একটা ভয়াবহ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার খুব নিকটবর্তী জায়গায় অবস্থান করছি। সুতরাং ভূমিকম্প এখানে সংঘটিত হবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আমাদের আশপাশে এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভূমিকম্প সংঘটিত হবে। বড় বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। ইতিহাস দেখলে পরিষ্কার ১৭৬২, ১৮৯৭, ১৯১৮, ১৯৩০, ২০১৫ বারবার বড় ভূমিকম্প হয়েছে। তাই ভবিষ্যতেও হবে, এতে সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অসংখ্য ইমারত তৈরি করা হয়েছে যেগুলোর অধিকাংশই ইমারত বিধিমালা মানা হয়নি। যে বিল্ডিং বেসমেন্ট তৈরি করা হলো পাঁচ তলার জন্য, লোভের বশবর্তী হয়ে সাত তলা বিল্ডিং করে ফেলে অনেকে দুই তলা বাড়িয়ে নেয়। তারা ভাবেন না যে এটা কতটা মারাত্মক। ভূমিকম্প সংঘটিত হলে এবং তার ধ্বংসযোগ্য হলে ধনী-গরিব, শিশু-বৃদ্ধ কারও পার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। পুরান ঢাকা বা ঢাকার কোনো কোনো জায়গায় এত ক্লোজলি স্পেসে বিল্ডিং আছে যেগুলো ধ্বংস হলে রানা প্লাজার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে। এক রানা প্লাজা ধ্বংস হওয়ার ফলে ওই জায়গায় সব জাতি একসঙ্গে কাজ করলেও ১৫ দিনে একটা বিল্ডিংকে উদ্ধার করা যায়নি। সেখানে যদি এসব ভবন ধসে পড়ে তাহলে ভয়াবহতা কেমন হবে তা কল্পনাও করা যায় না। মোহাম্মদপুরে একটা জায়গার নামই হলো জয়েন্ট কোয়ার্টার। পাশাপাশি কোয়ার্টারগুলোর মাঝখানে এক ইঞ্চি জায়গাও নেই। এক ওয়ালের মধ্যে পাশাপাশি বিল্ডিংগুলো লাগানো। অধ্যাপক আনোয়ার হোসাইন বলেন, আমরা তো এই দায়দায়িত্ব এড়াতে পারি না। এখন বলি যে আমরা গরিব দেশ আমাদের এত খরচ করার মতো সামর্থ্য নেই। তাহলে আপনি ২০ তলা বিল্ডিং বানাচ্ছেন না? যেখানে এত কোটি কোটি টাকা খরচ করে আপনি বিল্ডিং করছেন সেখানে ভূমিকম্প সহায় করার জন্য আরেকটু বেশি খরচ করলে অসুবিধা কী? মাত্র ৫.৭ হলে যদি এমন হয়, ৬ বা তার ওপরে হলে কী হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাত্রা ১ বাড়লেই ভূমিকম্পের শক্তি ১০ গুণ বৃদ্ধি পায়, আর এনার্জি রিলিজ হয় ৩২ গুণ বেশি। মানে ৫.৮ নয়, ৬.৫ মাত্রা হলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ভয়াবহ হবে।
একটা তুলনা দিলে পরিষ্কার হবে : হিরোশিমায় যেই এটম বোমা ফেলা হয়েছিল তার শক্তি ছিল কয়েক টনের সমান। আর ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের শক্তি প্রায় ৬০ লাখ টন বিস্ফোরণের সমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোর অবস্থা নিয়ে অধ্যাপক বলেন, ১৯৮৫ সালে ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে যে ট্র্যাজেডি ঘটে যায় তাতে অনেক ছাত্র নিহত হন। ওই সময়ের একটা ভঙ্গুর ইনফ্রাস্ট্রাকচার এর মধ্যে তারা বসে টিভি দেখছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত এ ধরনের অবকাঠামো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকটি আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর অ্যাপার্টমেন্ট অনেকটা এরকম। এটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তারপরও হলের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য কয়েকজন শিক্ষক সেই জায়গায় অবস্থান করছেন। আবার কোনো কোনো হলের অবস্থা খুব নাজুক। আমরা আরেকটি ১৫ অক্টোবর শোক দিবস পালন করার আগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতি জরুরি। শোক বার্তা প্রকাশ করা এবং দোয়া করার চেয়ে জীবিত থেকে আরও কিছু বছর পৃথিবীকে সেবা দিয়ে যাওয়া উত্তম বলে মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো ভবনগুলোর বেশির ভাগই ভূমিকম্প-সহনশীল মানদণ্ডে তৈরি হয়নি। অনেক জায়গায় প্লাস্টার খসে পড়ছে। এটাকে যৌথ ব্যর্থতা বলা যায়।
সমাধান নিয়ে তিনি বলেন, ১. ডিসেন্ট্রালাইজেশন : পুরান ঢাকা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে পরিকল্পিতভাবে নতুন উপশহরে স্থানান্তর করতে হবে। ২. নতুন ভবনকে অবশ্যই ইমারত কোড অনুযায়ী তৈরি করতে হবে। ৩. জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা : ভূমিকম্প শনাক্তকরণ ও পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে বড় গবেষণা দরকার। ৪. স্কুল কলেজে নিয়মিত ড্রিল : ভূমিকম্পের আগে, সময় ও পরে করণীয় শেখানো বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। ৫. উদ্ধার টিম গঠন ও প্রশিক্ষণ : দ্রুত প্রতিক্রিয়ার জন্য বড় ভলান্টিয়ার নেটওয়ার্ক দরকার। জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে দেরি করার সুযোগ নেই।
ব্যক্তি পর্যায়ে এখনই মানুষ কী করতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ১. নিজের বাড়ির সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা (বিম-কলামের নিচে, শক্ত আসবাবের পাশে) চিনে রাখতে হবে। ২. লিফট ব্যবহার করা যাবে না। ৩. সময় থাকলে ছাদে ওঠা নিরাপদ, নিচে নামা নয়। ৪. পরিবারের সবাইকে আগেই প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ৫. বাড়িতে অগ্নিনির্বাপক, টর্চলাইট, পানি ও ফার্স্ট এইড কিট রাখতে হবে।