ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধানবিষয়ক সংস্কার প্রস্তাবের ওপর গণভোট আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধান সংস্কার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধান হবে এই গণভোটে।
চারটি বিষয়ের ওপর অনুষ্ঠিত হবে এই গণভোট, যেখানে একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জনগণ তাদের মতামত জানাবেন। ‘হ্যাঁ’ ভোট বিজয়ী হলে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ, যারা অধিবেশন শুরুর ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। আর সংবিধান সংস্কারের ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে গঠন করা হবে উচ্চকক্ষ, যার মেয়াদ হবে নিম্নকক্ষের শেষ কার্যদিবস পর্যন্ত।
গতকাল দুপুরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা জানান। এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করা হয়। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করেন। রাষ্ট্রপতির আদেশের পর আইন মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করেছে। এরপর জাতির উদ্দেশে ভাষণে আদেশের বিষয়বস্তু ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির তথ্য তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা।
ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমরা সব বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজন করা হবে। এতে সংস্কারের লক্ষ্য কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে না। নির্বাচন আরও উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে উপযুক্ত সময়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই সনদের আলোকে আমরা গণভোটের ব্যালটে উপস্থাপনীয় প্রশ্নও নির্ধারণ করেছি। প্রশ্নটি হবে এ রকম : ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার-সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’
ক. নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
খ. আগামী সংসদ হবে দুইকক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
গ. সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
ঘ. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গণভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে আপনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে আপনার মতামত জানাবেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রায় দেড় যুগ ধরে আমাদের জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তারা আসন্ন নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। আগামী ফেব্রুয়ারিতে উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আমরা সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। সুষ্ঠুভাবে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অভ্যুত্থানের সপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তা না হলে জাতি এক মহাবিপদের সম্মুখীন হবে। এ সম্পর্কে আমি আগেও একাধিকবার আমার আশঙ্কা প্রকাশ করেছি।
তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের প্রণীত জুলাই সনদে সংবিধানবিষয়ক ৩০টি সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। কিছু প্রস্তাবে সামান্য ভিন্নমত আছে। অল্প কিছু প্রস্তাবে আপাতদৃষ্টে মনে হয় অনেক দূরত্ব আছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিক নয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ২০২৪-এর জুলাইয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে দেশবাসী যে ঐক্য গড়ে তুলেছিল, আমরা জীবিতরা যেন অল্পস্বল্প ভিন্নমত ও লঘু বিবাদে জড়িয়ে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করি। জুলাই অভ্যুত্থানে ১৩৩ শিশু, শত শত তরুণ-তরুণী ও নারী-পুরুষের মৃত্যু এবং হাজার হাজার মানুষের অঙ্গহানির যে আত্মত্যাগ সেটিকে আমাদের সম্মান জানাতেই হবে। আমরা যেন দলীয় স্বার্থ অতিক্রম করে, সম্মিলিত আকাক্সক্ষা ও জাতীয় চাওয়াকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি। আমি আশা করি আমাদের এই সিদ্ধান্ত জাতির বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে। একটি উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচনের দিকে জাতি এগিয়ে যাবে। এর মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করব।