এ দেশে সব সময়ই গুণীজনদের অবহেলা করা হয়। এর মাঝে আলেমদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের অবহেলা সবচেয়ে বেশি। অথচ আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। শৈশব থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের জন্যই আলেমদের নানামুখী কর্মসূচি আছে। আলেমরা কোমলমতি শিশুদের জন্য প্রভাতি মক্তবের ব্যবস্থা রেখেছেন। যেখান থেকে তারা দীন ও নৈতিকতার পাঠ নিয়ে বড় হয়। এভাবে যুগ যুগ ধরে চলে আসা মক্তবের মাধ্যমে এ দেশের আলেমরা জাতির মানস গঠনে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছেন।
আলেমদের অবদানের কথা বলতে গেলে সবার আগে মসজিদের মিম্বর ও মাহফিলের কথা চলে আসে। মিম্বর এমন একটি জায়গা, যে জায়গাটি সাত দিন পরপর অনিবার্যভাবে কথা বলে ওঠে। বাংলাদেশে প্রায় তিন লাখ জামে মসজিদ রয়েছে। প্রত্যেক জুমার দিনে একযোগে একই সময়ে তিন লাখ খতিব মুসল্লিদের সামনে দীন, নৈতিকতা এবং সমকালীন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন। শ্রোতারা নামাজের পাশাপাশি খতিবের আলোচনা শোনার উদ্দেশ্যে অজু-গোসল করে, পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মিম্বরের সামনে উপস্থিত হন। মিম্বর ও মাহফিল থেকে দীনের মৌলিক শিক্ষা তো দেওয়া হয়-ই, পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়, সংকট ও অস্থিরতা তৈরি হলে খতিবরা সে বিষয়েও জনগণকে সতর্ক করেন। দেশে যখন ধর্ষণ বেড়ে যায়, আলেমরা ধর্ষণের ভয়াবহতা, শাস্তি এবং এর ইহকালীন-পরকালীন ক্ষতির বিষয়ে যুবকদের সজাগ করেন। দেশে যখন হত্যা, রাহাজানি, যৌতুক, মাদক, দুর্নীতি বেড়ে যায়, আলেমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেসব বিষয় নিয়েও সময়োপযোগী আলোচনা উপস্থাপনা করেন। একসময়ের জঘন্য সামাজিক অপরাধ যৌতুককে আজ সবাই ঘৃণা করে। এটা আলেমদের দীর্ঘদিনের ওয়াজ-নসিহতের ফসল। এ দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। কওমি-আলিয়া মিলিয়ে সংখ্যাটা ৫০ হাজারের কাছাকাছি। এই মাদ্রাসাগুলোতে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পেছনে রাষ্ট্রকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়, মাদ্রাসার পেছনে তার সিকিভাগও, বিশেষত কওমি মাদ্রাসার পেছনে খরচ করতে হয় না। বরং আলেমরা স্ব-উদ্যোগে জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মাদ্রাসার খরচ চালাতেন। এভাবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি, সহানুভূতি ও সহযোগিতা ছাড়াই আলেমরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সুনাগরিক উপহার দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন। আবার মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভিতর অপরাধপ্রবণতা নেই বললেই চলে। এ দেশে প্রতিদিনই নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। কিন্তু মাদ্রাসার কোনো শিক্ষার্থী খুন বা ধর্ষণ করেছে, মাদকাসক্ত হয়েছে, চোরা কারবারে জড়িয়েছে- এমন সংবাদ তেমন একটা চোখে পড়ে না। শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া দীন ও নৈতিক শিক্ষায় তারা এমনভাবে বেড়ে ওঠে, আলোকিত শিক্ষা তাদের অপরাধকর্ম থেকে বিরত রাখে।
আবার প্রায় সব কওমি মাদ্রাসায় লিল্লাহ বোর্ডিং সিস্টেম চালু রয়েছে। যেখানে কয়েক লাখ এতিম শিশু-কিশোর বিনামূল্যে থাকাখাওয়া ও পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। এই সুযোগ যদি না থাকত, তবে ঝরে পড়া এই এতিম শিশুদের অনেকেরই নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হতো। তার মানে, মাদ্রাসায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা তো সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠছেই, পাশাপাশি, এতিম-অসহায় শিশু-কিশোর, যাদের ভবিষ্যৎ ছিল অনিশ্চিত, তাদেরও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছেন আলেমরা। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এতটাই শান্ত ও সুশৃঙ্খল, কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এক ক্যাম্পাসে পড়াশোনা ও রাতযাপন করলেও তাদের মাঝে কখনো সংঘাত-সংঘর্ষ ও আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে না। থানায় প্রতিদিনই বহু মানুষের নামে মামলা হয়, কিন্তু তাদের মাঝে আলেমদের নাম পাওয়া যায় না বললেই চলে। অর্থাৎ আলেমরা নিজে সৎ থেকে, শিক্ষার্থীদের সৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। প্রতি বছর এ দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। বিপরীতে আলেমদের মাধ্যমে বিদেশ থেকে যে পরিমাণ ডোনেশন আসে, তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা গেলে রাষ্ট্রের প্রতি তাদের অবদানের সঠিক চিত্র আমরা দেখতে পেতাম। মানবসেবা ও সামাজিক কাজেও আলেমরা অন্য সবার থেকে এগিয়ে থাকেন। এ দেশে যখনই কোনো দুর্যোগ দেখা দেয়, মানবতার সেবায় সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েন আলেমরা। করোনা মহামারিতে সবাই যখন ঘরবন্দি, তখনও আলেমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্বেচ্ছায় লাশ দাফনের মতো মহামানবিক কাজ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে আলেমদের সামনের সারিতে দেখা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি আলেমদের এত অবদান থাকা সত্ত্বেও তাদের অবদান সেভাবে স্বীকার করা হয় না।
জুমার মিম্বর থেকে
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ