জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থান দমনে সারা দেশে ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল পুলিশ। এর মধ্যে শুধু ঢাকা মহানগরীতেই ছোড়া হয়েছে ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর নিজের জবানবন্দিতে এ তথ্য তুলে ধরেন।
গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ প্রসিকিউশনের ৫৪তম সাক্ষী হিসেবে দ্বিতীয় দিনের মতো জবানবন্দি দেন তিনি। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি জবানবন্দিতে বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশ এলএমজি, এসএমজি, চায়নিজ রাইফেল, শর্টগান, রিভলবার, পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করে। তাঁর দ্বিতীয় দিনের জবানবন্দির প্রথম অংশ সরাসরি সম্প্রচার করা হয় বিটিভি ও চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে। গতকালও তাঁর জবানবন্দি শেষ না হওয়ায় আজ আবারও দিন রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলার বাকি দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে এ মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকালও তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এ সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ। পলাতক দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য আগামী ১৪ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে উত্তরায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মো. সোহেল রানা ও মো. শাহ আলমকে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আর ট্রাইব্যুনাল-২ এ রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে।
শেখ হাসিনার মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা তার দ্বিতীয় দিনের জবানবন্দিতে জুলাই শহীদ, জুলাই যোদ্ধাদের তালিকা-সংক্রান্ত বেশ কিছু গেজেট জব্দ করার তথ্য দেন। একই সঙ্গে জুলাই-আগস্টের ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রচারিত-প্রকাশিত সংবাদ ও ভিডিও ক্লিপ জব্দ করার কথাও জানান। পাশাপাশি এ আন্দোলন-সংক্রান্ত বেশ কিছু বই, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অধিকারসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন জব্দ করার কথাও জবানবন্দিতে জানিয়েছেন তিনি।
জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর বলেন, তদন্ত চলাকালে চলতি বছর ২৫ জানুয়ারি এক স্মারকের মাধ্যমে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জুলাই আন্দোলন দমনে ছাত্র-জনতার ওপর ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলি-সংক্রান্ত ২১৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন পেয়েছি। একই সঙ্গে র্যাব সদর দপ্তর থেকে হেলিকপ্টার ব্যবহার-সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে।
জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, জুলাই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হত্যা, জখম, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সংগ্রহ করে জব্দ করা হয়েছে। তিনি বলেন, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল, জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে জখমি সাক্ষীদের চিকিৎসা সনদ সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম থেকে ৮১ জন অজ্ঞাতনামা লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনও সংগ্রহ করা হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা জবানন্দিতে আরও বলেন, তদন্তকালে সংগৃহীত, জব্দকৃত আলামত পত্রপত্রিকায় ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপ, বইপুস্তক, বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট, বিভিন্ন প্রতিবেদন, শহীদ পরিবারের সদস্য, জখমি, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের জবানবন্দি, সাবেক আইজিপি মামুনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত পর্যালোচনা করি। পলাতক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ও আইজি মামুন গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ব্যাপক মাত্রায় আন্দোলন দমনে শান্তিপূর্ণ ছাত্রজনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন।
ইনুর বিরুদ্ধে করা মমালায় অভিযোগ গঠন শুনানি ১৪ অক্টোবর : জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য আগামী ১৪ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আবেদনে শুনানির এ দিন ধার্য করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
এ মামলার অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানির জন্য এক সপ্তাহ সময় চেয়ে আবেদন করেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম। ইনুর আইনজীবী নাজনীন নাহারও সময় চেয়ে আবেদন করেন। শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল ১৪ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর প্রসিকিউশন এ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করলে তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
তার বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিভিন্ন পর্যায়ে উসকানি, ষড়যন্ত্র, হত্যা, আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার ও নিপীড়নমূলক কৌশলে সমর্থনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি অভিযোগ আনা হয়েছে। গতকাল হাজির করা হলে এ মামলায় ট্রাইব্যুনাল তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে রাখার নির্দেশ দেন।
দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে হাজিরের নির্দেশ : এদিকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে উত্তরায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মো. সোহেল রানা ও মো. শাহ আলমকে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আগামী ২২ অক্টোবর তাদের হাজির করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন, প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আল নোমান। ওইদিন এ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের দিন ধার্য আছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর এ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলামও এ মামলার আসামি।
সাবেক তিন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি : ২০১৬ সালে যশোরের চৌগাছায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুজন নেতার পায়ে গুলি করার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) আকিকুল ইসলামসহ তিন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। অন্য দুজন হলেন- চৌগাছা থানার তৎকালীন কনস্টেবল সাজ্জাদুর রহমান ও কনস্টেবল জহরুল হক। প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পালোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সুবিধাজনক সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সেফহোমে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলা হয়েছে।’
আবু সাঈদ হত্যার মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ অব্যহত : শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ-২ এ প্রসিকিউশনের নবম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন একই বিশ^বিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আরমান হোসেন। পরে তাকে জেরা করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলায় আরও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।