জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় ১৬ এবং চানখাঁরপুলের ঘটনায় করা মামলায় ৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এসব সাক্ষীর জবানবন্দিতে উঠে এসেছে পুলিশের বর্বরতার চিত্র। সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছেন, পুলিশ গুলি করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের যেমন হত্যা করেছে, তেমনই আহত আন্দোলনকারীদের চিকিৎসায়ও বাধা দিয়েছে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষীরা এসব জবানবন্দি উপস্থাপন করেন। ঘটনার জন্য পুলিশের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তাঁর সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও দলের নেতা-কর্মীদের দায়ী করেছেন সাক্ষীরা। চেয়েছেন যথাযথ বিচার।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত বছর জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা পড়েছে ৪৫১টি। এর মধ্যে ৩০টি মিস কেস (বিবিধ মামলা) দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ২০৯ জন। ৮৪ জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় জানায়, এখন পর্যন্ত চারটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। তিনটি মামলায় অভিযোগ গঠন হয়ে দুই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। আরও বেশ কয়েকটি মামলায় খুব শিগগিরই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হবে। ৩ আগস্ট শেখ হাসিনার মামলায় ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন ২৩ বছর বয়সি মাইক্রোবাসচালক খোকন চন্দ্র বর্মন। তিনি যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিজের মুখমণ্ডলের অবয়ব বিকৃত হয়ে যাওয়ার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, গত বছর ৫ আগস্ট দুপুরের পর যখন খবর আসে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, তখন সেনাবাহিনী চলে যায়, ওই সময় পুলিশ থানা থেকে বেরিয়ে পাখির মতো গুলি করতে থাকে। ওই সময়ই মাথায় টার্গেট করে করা এক পুলিশ সদস্যের গুলি তাঁর মাথায় লাগে।
এ গুলিতেই তাঁর এক চোখ ও নাক নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বিকৃত হয়ে যায় মুখমণ্ডলের অবয়ব। ৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ২৫ বছর বয়সি আবদুল্লাহ আল ইমরান। তাঁর হাঁটুর নিচে গুলি লাগার কথা জানিয়ে বলেন, ‘পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে শেখ হাসিনাকে “নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট” নির্দেশ দিতে শুনেছি।’ একই দিন প্রসিকিউশনের তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো ২৭ বছর বয়সি পারভীন। তিনি বলেন, ‘গত বছর ১৮ জুলাই বিকালে কাজ শেষে বাসায় যাচ্ছিলাম। যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসার পর দেখতে পাই রাস্তার ওপরে অনেক মানুষ পড়ে আছে।
কারও হাত নাই, কারও পা নাই। ফ্লাইওভারের নিচে দেখি একটি ছেলে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। তার সারা শরীর রক্তাক্ত। দুই চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি ছেলেটির বয়স ১৮-১৯ হবে। তাকে টেনে তুলে রিকশা খুঁজছিলাম। এমন সময় ১৪-১৫ জন সশস্ত্র পুলিশ মারমুখী হয়ে ছেলেটিকে লক্ষ করে গুলি করতে থাকে। আমি বাম হাত তুলে গুলি না করার অনুরোধ করলে এক পুলিশ আমার বাম চোখে গুলি করে।’ ৬ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন রংপুরে আবু সাঈদকে গুলি করতে দেখা দুই প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। এর মধ্যে একজন আন্দোলনকারী রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রিনা মুর্মু এবং অন্যজন এনটিভির রংপুরের সিনিয়র করেসপনডেন্ট এ কে এম মঈনুল হক। ১১ আগস্ট চানখাঁরপুলের ঘটনায় করা মামলায় ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন এ এলাকায় পুলিশের গুলিতে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার খান আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘এক আন্দোলনকারীর ফোন পেয়ে আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার শ্বশুর মিটফোর্ড হাসপাতালে যাই। জরুরি বিভাগের সামনে স্ট্রেচারে রক্তাক্ত অবস্থায় আমার সন্তানের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পাই।’ ১৩ আগস্ট আরও তিনজন জবানবন্দি দেন চানখাঁরপুলের ঘটনার। ১৭ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মামলায় জবানবন্দি দেন ঢাকার আশুলিয়ায় পুলিশের পিকআপ ভ্যানে পুড়িয়ে হত্যা করা সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহীনা বেগম। পুলিশের পোড়া পিকআপ ভ্যানে পায়ের পোড়া জুতা দেখে ছেলের লাশ শনাক্ত করার কথা জানান তিনি। একই দিন খুলনা হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কলেজের শিক্ষার্থী নাইম শিকদার গত বছর ৪ আগস্ট বিকালে খুলনার শিববাড়ী মোড়ে পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি নিজের পিঠে গুলির চিহ্ন দেখিয়ে ট্রাইব্যুনালকে বলেন, এখনো গুলিগুলো তাঁর শরীরে রয়েছে।
যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত ইমাম হাসান ভূঁইয়া তায়িমের বড় ভাই রবিউল আওলাদ ভূঁইয়া। তিনি জবানবন্দিতে বলেন, ‘তায়িমকে গুলি করেছিলেন পুলিশের তৎকালীন এডিসি শামীম, ওসি জাকির হোসেন ও এসআই সাজ্জাদুজ্জামান। পুলিশ ভ্যানে করে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নেওয়া হয় তাকে। ভ্যান থেকে মাটিতে নামিয়ে পাঁচ-ছয় জন পুলিশ সদস্য বুট জুতা দিয়ে মাড়িয়ে তায়িমের চেহারা বিকৃত করে ফেলে।’ একই দিন সাক্ষ্য দেন আশুলিয়া থানার সামনে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে পুড়িয়ে হত্যার শিকার আস সাবুরের বাবা মো. এনাব নাজেজ জাকি ও রাজশাহীতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া জসিম উদ্দিন। ২০ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন দুই চিকিৎসক। তাঁদের বর্ণনায় এসেছে আহতদের চিকিৎসা না দিতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বলপ্রয়োগের বিষয়। গত বছর ১৯ জুলাইয়ের ঘটনা জানিয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিওরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘ওই দিন রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। তখন ডিবির লোকেরা এসে নতুন গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করতে আমাকে চাপ দেয়। বলে, আপনি অতি উৎসাহী হবেন না। বিপদে পড়বেন।’
ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কল্যাণপুর শাখার সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাসানুল বান্না তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর ১৮ জুলাই সন্ধ্যার পর পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হাসপাতালে এসে চিকিৎসায় বাধা দেয় এবং রোগী ভর্তি করতে নিষেধ করে। ১৯ জুলাই সকাল থেকে সারা দিন যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের গেট অবরোধ করে রাখে।’