জুলাই সনদ সংবিধানের ওপরে রাখার বিষয়ে আপত্তি জানালেও আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান সম্ভব বলে আশাবাদী বিএনপি। তবে নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান দলটির হাইকমান্ডের। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় এখনো পিআর পদ্ধতি উপযোগী নয়।
অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে প্রদত্ত জুলাই সনদের লিখিত খসড়ায় মতামত জমা দিয়েছে দলটি। জুলাই সনদ সংবিধানের ওপরে রাখা বা না রাখা এবং নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির বিষয় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে শিগগিরই আলোচনায় বসবেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। আলোচনার মাধ্যমেই জুলাই সনদ প্রণয়ন, স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন করতে চায় দলটি।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে দেশের জনগণ এ পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত নয়। ফলে এ অযৌক্তিক পিআর পদ্ধতি কখনোই দেশের সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করবে না। নির্বাচন বিঘ্নিত বা বানচাল করতে সম্পূর্ণ অসদুদ্দেশ্যেই পিআর পদ্ধতি দাবি করা হচ্ছে মনে করছেন তাঁরা। পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। কারণ দেশের জনগণের অধিকার রয়েছে জানার-তারা কাকে ভোট দিচ্ছেন এবং কে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রস্তাবিত পিআর পদ্ধতিতে কোনো ব্যক্তিকে সরাসরি নির্বাচিত করার সুযোগ না থাকায় জনগণ স্পষ্টভাবে জানতে পারছেন না তারা কাকে সংসদে পাঠাচ্ছেন। তাই জাতীয় সংসদ কিংবা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলে রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে অবশ্যই জনগণের মুখোমুখি হয়ে তাদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। জনগণের রায় নিয়ে নির্বাচিত হতে হবে।’
অন্যদিকে জুলাই সনদের বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধানের প্রত্যাশা করেছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জুলাই সনদের তিনটি অংশ রয়েছে। এক. ভূমিকা, দুই. ৮৪ দফা প্রস্তাব এবং তিন. অঙ্গীকারনামা। ভূমিকার মধ্যে যে কয়টা বাক্য আছে সেগুলো ঠিক আছে। আর দফা ৮৪টির মধ্যে কিছু কিছু অসামঞ্জস্য আছে। এ দফাগুলো আমরা ঠিকঠাক করে দিয়েছি। আর অঙ্গীকারনামার মধ্যে বেশ কিছু অসামঞ্জস্য আছে। এর মধ্যে তিন- চারটি দফা আছে যেগুলো খুবই অযৌক্তিক। যেমন সনদটাকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া। এতে একবার বলা হয়েছে-এ নিয়ে ভবিষ্যতে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না। আবার বলা হয়েছে-শুধু আপিলেট ডিভিশনই এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। কাজেই এ বিষয়টি নিয়ে “কোনো আইনি বা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া”য় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে বলে আমরা আশাবাদী। আমরা প্রত্যাশা করি, আলোচনার মাধ্যমেই সংবিধানের মধ্যে আইনি বৈধতা এবং সাংবিধানিক কোনো প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ প্রণীত হবে, স্বাক্ষরিত হবে এবং বাস্তবায়িত হবে।’
জানা গেছে, এতে জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে যতটা ছাড় দেওয়া দরকার, ততটাই ছাড় দিয়েছে বিএনপি। দলটির এখন প্রত্যাশা, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণীত, স্বাক্ষরিত ও বাস্তবায়িত হবে। তবে অঙ্গীকারনামায় থাকা কয়েকটি প্রস্তাবে দলীয় ভিন্নমত থাকলেও আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এর আইনি বৈধ এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা যাবে বলে বিশ্বাস দলটির। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য কমিশন আগামীতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে বৈঠকের পরিকল্পনা করছে, সেখানেও এ ব্যাপারে বিএনপি তাদের যৌক্তিক মত তুলে ধরবে দলটি। সূত্র আরও জানান, জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করতে সোমবার রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমদসহ তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। মঙ্গলবার রাতে আবারও বৈঠক করেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। বৈঠকে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া প্রস্তাবগুলো নিয়েও পর্যালোচনা হয়। এ সময় জুলাই সনদের আট দফা অঙ্গীরকারনামাকে অপ্রয়োজনীয় বলেও মনে করেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। অঙ্গীকারনামার চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, জুলাই সনদের প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে। বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এমন বিষয়ে স্থায়ী কমিটির কেউ কেউ এটাকেও গ্রহণযোগ্য নয় বলে মত ব্যক্ত করেন। তাঁদের মতে কোনো ডকুমেন্ট বা নথির অবস্থান সংবিধানের ওপরে হতে পারে না। অর্থাৎ জুলাই সনদ সংবিধানের ওপরে জায়গা দেওয়ার সুযোগ নেই। এ নিয়ে বুধবার ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও এলডিপির সঙ্গেও বৈঠক করে বিএনপি। মঙ্গলবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চ, বিজেপি, গণপরিষদের সঙ্গে বৈঠক করেন দায়িত্বশীল নেতারা। বৈঠকে জুলাই সনদ নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের অভিন্ন বা কাছাকাছি মতামত দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় আগের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া বিষয়গুলো সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় না এলে সেটা উল্লেখ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মতামত জমা দেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।