প্রেস সচিবের এক বক্তব্যে তোলপাড় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝেও। ৩১ জুলাই প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য আগামী চার-পাঁচ দিন ক্রুশিয়াল।’ তাঁর ওই মন্তব্য ঘিরে চলছে নানান আলোচনা। আগামী চার-পাঁচ দিন কেন ক্রুশিয়াল? কেন তিনি এমন কথা বললেন? আগামী চার-পাঁচ দিন রাজনৈতিক অঙ্গনে কী কী ঘটতে পারে, তার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত অনেকেই। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর এ বক্তব্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে।
দেশের রাজনীতিতে তাহলে নতুন কিছু ঘটতে চলেছে? নাকি সরকারের মধ্যে কিছু হতে যাচ্ছে! রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রেস সচিবের এ মন্তব্য মোটেও হালকাভাবে দেখছেন না। প্রেস সচিব হলেন সরকারের মুখপাত্র। এমন ব্যক্তি যখন কিছু বলেন তা অবশ্যই ইঙ্গিতবহ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেস সেক্রেটারির কাছ থেকে এমন সময়ে এ ধরনের মন্তব্য এলো যখন জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে চলছে এক ধরনের টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা ও আস্থার সংকট। আবার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার ইস্যুটিও রয়েছে ‘হট কেক’ হিসেবে। সব মিলিয়ে আগামী কয়েক দিন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে রহস্যের ধূম্রজাল!
বৃহস্পতিবার বিএসআরএফ সংলাপে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আগামী চার-পাঁচ দিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য একটি ক্রুশিয়াল (খুব গুরুত্বপূর্ণ) সময়। এ কয়েক দিনে বোঝা যাবে সামনে কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত, নির্বাচন দেরি হবে না। প্রধান উপদেষ্টা যে সময় বলেছেন, তার থেকে একটা দিনও দেরি হবে না।’ তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা প্রথমে বলেছিলেন নির্বাচন এপ্রিলের প্রথমার্ধে হবে। পরবর্তী সময়ে লন্ডনে বলা হয়েছে, যদি অনেক সংস্কার হয় এবং বিচারের কাজগুলো এগিয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে এটা ফেব্রুয়ারিতে হবে। তাঁরা সে জায়গায় এখনো আছেন। এটি এক দিন দেরি হবে না, যা-ই হোক না কেন। সনদ বা ঘোষণাপত্র যা-ই হোক না কেন, যেভাবেই সনদ গ্রহণ করা হোক না কেন, নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে। এ বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূসের দৃঢ় অবস্থান, পুরো উপদেষ্টা পরিষদেরই এখানে দৃঢ় অবস্থান। উপদেষ্টারা তাঁদের পুরোনো কাজে ফিরে যেতে চাচ্ছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশা করি এ নির্বাচনটা খুবই উৎসবমুখর পরিবেশে ভালো নির্বাচন হবে। প্রতিটি নির্বাচনে কিছু না কিছু ভায়োলেন্স হয়, আমাদের একেবারে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকবে ভায়োলেন্স একেবারে জিরোতে নামিয়ে আনা।’ প্রেস সচিবের বক্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত সময়টা বাংলাদেশের জন্য ক্রুশিয়াল। যতদিন পর্যন্ত এ দেশে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচিত সরকার না আসবে, ততদিন পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। সে বিবেচনা থেকে যদি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ক্রুশিয়াল সময় নিয়ে মন্তব্য করে থাকেন তাহলে বিষয়টি খুবই স্পষ্ট।’ শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘৫ আগস্ট এ দেশ থেকে দীর্ঘদিনের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটেছিল। সে ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আওয়ামী লীগের নেতা, হাসিনার অনুগত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের সীমাহীন লুটপাটের কারণে এ কাঠামো ভেঙে যায়। তারা আবার ফিরে আসতে পারে। পলাতক শেখ হাসিনা পাশের দেশে আশ্রয় নিয়ে নিয়মিত এ ধরনের হুমকিধমকি দিচ্ছেন। এসব বিবেচনা থেকে যদি শফিকুল আলম এসব কথা বলে থাকেন তাহলে এটা অবশ্যই ক্রুশিয়াল টাইম।’ একই প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের প্রেস সচিব যে কথা বলেছেন, তার কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে জুলাই বর্ষপূর্তি হয়েছে। এ বর্ষপূর্তিতে মানুষের মধ্যে জুলাইয়ের স্মৃতি চাঙা হয়েছে। এখন জুলাইয়ের অর্জনটা ধরে রাখার নানান চ্যালেঞ্জ দেখছেন তাঁরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘জুলাইয়ের অর্জনটা বানচাল করার জন্য ফ্যাসিবাদী শক্তি ওত পেতে আছে। যেন সরকারকে অস্থির রেখে নির্বাচন বানচাল করা যায়। নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটানো যায়। সংস্কার কার্যক্রম বানচাল করা যায়। আর আইনশৃঙ্খলার অবনতি করা যায়। যেহেতু সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে তার মূল্যায়ন করে পরবর্তী ধাপ পরিকল্পনায় নিতে বাধা দেওয়া যায়। মোট কথা সরকারকে অস্থিতিশীল রাখা।’ হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘এমনও হতে পারে সরকার নিজেদের পুনর্বিন্যাস করার পরিকল্পনায় রয়েছে। তবে এর জন্য সবাইকে সতর্ক হতে হবে। বিভাজন তৈরি না করে সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। আমরা যে কোনো পরিস্থিতি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আছি।’ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব মুশফিক উস সালেহীন বলেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যে এক বছর ধরে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার ফলাফল পেতে যাচ্ছি আমরা। বহুলপ্রত্যাশিত জুলাই সনদ, ঘোষণাপত্র আসতে যাচ্ছে। যেগুলো আগামীর বাংলাদেশের ভিত্তি ও গতিপথ নির্মাণ করবে। সব মিলিয়েই এ কয়েকটা দিন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এসব বিষয় নিয়ে তেমন কোনো শঙ্কা দেখতে পাচ্ছি না। তবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া সরকার যদি নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হয়, তাহলে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে।’