জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিপর্যস্ত তিনটি খাত হচ্ছে- বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বেসরকারি খাত। প্রস্তাবিত বাজেটে এই তিন খাতের জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকটসহ নানা কারণে দেশীয় শিল্প বিপাকে আছে। একের পর এক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে বেকারত্ব। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যেখানে বেসরকারি খাতকে উজ্জীবিত করতে ব্যাপকভিত্তিক প্রণোদনামূলক উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল-সেখানে উল্টো এ তিনটি খাত সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। প্রস্তাবিত বাজেটেও তিনি এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বাজেট বক্তৃতায় তিনি উল্লেখ করেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তিনি ধারাবাহিকভাবে বিগত মাসগুলোতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াইয়ের কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অন্যান্য বারের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দেওয়ায় অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন খাত বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বেসরকারি খাত গুরুত্বের বাইরেই রয়ে গেছে।
কীভাবে?- বাজেটে ঘাটতি মোকাবিলায় দেশের ভিতর থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধার নেবে ব্যাংক খাত থেকে, যার পরিমাণ ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধনী বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ৯৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
গত বছরের জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মাস আগস্টে কিছুটা কমলেও তা ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। তবে গত পাঁচ মাসে তা কমতে কমতে ৮ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে সাড়ে ৭ শতাংশের কাছাকাছি উঠেছে। আগের মাসে তা ছিল ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এমনিতেই তারল্য সংকটে আছে। বেসরকারি খাত ঋণ পাচ্ছে না। সুদের হার বেশি বলে নতুন বিনিয়োগও হচ্ছে না। এ অবস্থায় লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যাংক থেকে সরকার নিয়ে গেলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে না। ফলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব আরও বাড়বে।
প্রস্তাবিত বাজেটে কর্মসংস্থান নিয়েও কোনো দিকনির্দেশনা নেই। আগের বাজেটের মতো কিছু গৎবাঁধা কথা আছে। আছে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি আর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ক্ষতিগ্রস্ত আরেকটি খাত হচ্ছে কর্মসংস্থান। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণ অভ্যুত্থান এবং পরবর্তীতে ঢাকার প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ওই সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে কয়েক লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে দেশের বেকার জনগোষ্ঠী বেড়ে ২৭ লাখ ৩০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৪ লাখ। অর্থাৎ সরকারি হিসাবে এক বছরে বেকারত্ব বেড়েছে ৩ লাখের বেশি। এ বেকারত্ব দূরীকরণে বাজেটে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ চোখে পড়েনি; বরং ড. ইউনূসের চাকরি করব না, চাকরি দেব-নীতিতে বলীয়ান হয়ে বাজেটে আত্মকর্মসংস্থানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন বাজেটে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সারা দেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের ঋণের সিলিং ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। সফল উদ্যোক্তাদের ঋণের সিলিং বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।
তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে ১০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। জুলাই অভ্যুত্থানে আহত পরিবারের সদস্যদের জন্যও আত্মকর্মসংস্থানের উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু আগামী বছর তারুণ্যের উৎসব করতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের বিষয়ে নেই কোনো উদ্যোগ। প্রতি বছর যে ২০ লাখ শ্রমিক কর্মবাজারে প্রবেশ করে- কীভাবে তাদের কর্মসংস্থান হবে- সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই বাজেটে। বিগত সরকারের মতো গৎবাঁধা বক্তব্যে কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং বিদেশে কর্মী প্রেরণের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে দায়িত্ব শেষ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতটি সবেচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নানা দুর্নীতি ও অপশাসনের কারণে অর্থনীতি এমনিতেই ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। অভ্যুত্থানের পর দেশের শিল্পোদ্যোক্তরা ভেবেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকার দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় মনোযোগ দেবে; বরং বিগত কয়েক মাসে ঘটেছে তার উল্টো। শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট আরও বেড়েছে। বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোতে ঋণ মেলেনি। উল্টো সুদের হার বেড়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বড় উদ্যোক্তাদের হয়রানি করা হয়েছে। ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। মিথ্যা অভিযোগে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে।
নতুন বাজেটে সুখবরের আশায় ছিলেন ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা। সে আশায় গুড়ে বালি। বরং বাজেটে এমন কর প্রস্তাব করা হয়েছে যেখানে দেশীয় শিল্প হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাজেটের কর প্রস্তাব পর্যালোচনা করে বলা যায়, অর্থ উপদেষ্টা দেশীয় শিল্পের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করেছেন। শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা বাতিল করা হচ্ছে। ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, আয়রন, রাইস কুকার, প্রেসার কুকার ইত্যাদি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা কিছুটা কমানো হয়েছে। মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজনের ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধাও কমানো হয়েছে। এতে ইলেকট্রনিক্স শিল্পের সুরক্ষা কমবে, বিদেশি ইলেকট্রনিক্স-সামগ্রী আমদানি বাড়বে। থালাবাসনসহ প্লাস্টিকের তৈজসপত্র, গৃহস্থালি সামগ্রী ও সমজাতীয় পণ্যে ভ্যাটের হার বাড়ানোর হচ্ছে। এসব পদক্ষেপের ফলে দেশীয় শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শুধু বড় শিল্প নয়, ক্ষতির মুখে পড়বেন ছোট ছোট উদ্যোক্তারাও। দেশের লাখো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা অল্প পুঁজি নিয়ে অনলাইনে ব্যবসাবাণিজ্য করছেন। এ অনলাইনে পণ্য বিক্রয় কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে। এতে অনলাইনে কেনাকাটায় ব্যয় বাড়বে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী ‘থ্রি জিরোস’ বা ‘তিন শূন্য’ বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাঁর এই তিন শূন্যের মূল কথা হচ্ছে- শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ। অর্থাৎ শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ এমন এক পৃথিবী গড়তে চান যেখানে কোনো দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন দূষণ থাকবে না। ড. উইনূসের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও তাঁর অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যে বাজেট ঘোষণা করেছেন সেখানে শূন্য বিনিয়োগ, শূন্য কর্মসংস্থান এবং শূন্য বেসরকারি খাত- এই তিন শূন্য ছাড়া তেমন কিছুই মেলেনি।