প্রকৃতি এমন সব অদ্ভুত ও বিস্ময়কর প্রাণীতে ভরপুর, যাদের আচরণ ও শারীরিক গঠন আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। অক্টোপাস ঠিক তেমনই এক প্রাণী, যার বৈশিষ্ট্য প্রাণিজগতে একেবারে অনন্য। এর দেহের গঠন এতটাই ব্যতিক্রমী যে, বিজ্ঞানীরাও একে প্রাণিজগতের বিস্ময় বলে আখ্যা দেন। অক্টোপাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর রয়েছে তিনটি হৃদয় ও নয়টি মস্তিষ্ক।
তিনটি হৃদয়ের মধ্যে দুটি হৃদয় অক্টোপাসের শ্বাসযন্ত্রে রক্ত পাঠায় এবং বাকি একটি প্রধান হৃদয় পুরো দেহে রক্ত সঞ্চালন করে। আশ্চর্যজনকভাবে যখন অক্টোপাস সাঁতার কাটে, তখন তার প্রধান হৃদয়টি বিশ্রামে চলে যায় এবং রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য অক্টোপাস সাধারণত বেশি সময় সাঁতার কাটে না, বরং ঠান্ডা ও স্থির পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে।
এর চেয়েও বেশি বিস্ময়কর হলো, অক্টোপাসের নয়টি মস্তিষ্ক। একটি কেন্দ্রীয় মস্তিষ্ক ছাড়াও প্রতিটি বাহুর জন্য আলাদা মস্তিষ্ক রয়েছে। এই বাহুগুলো নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যেমন খাদ্য অনুসন্ধান, শিকার ধরা, অথবা বিপদের সময় প্রতিক্রিয়া জানানো। বিজ্ঞানীরা বলছেন, অক্টোপাসের প্রতিটি বাহু একটি স্বতন্ত্র চিন্তাশক্তিসম্পন্ন ইউনিটের মতো কাজ করে।
এই স্বতন্ত্র মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের সম্মিলিত কাজের ফলেই অক্টোপাস অত্যন্ত বুদ্ধিমান একটি প্রাণী হিসেবে স্বীকৃত। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, অক্টোপাস সমস্যা সমাধান করতে পারে, চ্যালেঞ্জিং পাজল বুঝতে পারে এবং এমনকি মানুষের চেহারা পর্যন্ত চিনতে পারে। অনেক সময় তারা মানুষের প্রতি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে এবং স্মৃতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এই অদ্ভুত গঠন ও আচরণ শুধুই একটি প্রাণীর পরিচয় নয়, বরং প্রকৃতির অদৃশ্য বিস্ময় ও বিবর্তনের দৃষ্টান্ত।
এ ছাড়া অক্টোপাসের রয়েছে এক অবিশ্বাস্য প্রতিরক্ষা কৌশল। এরা রং ও ত্বকের গঠন মুহূর্তেই পরিবর্তন করতে পারে, যা তাকে আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে একাকার করে দেয়। এ কৌশলটি কেমোফ্লাজ নামে পরিচিত। শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে অক্টোপাস কালি ছুড়ে দেয়, যা শিকারিকে বিভ্রান্ত করে এবং সে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে।
তাদের রক্তের রংও অন্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা। অক্টোপাসের রক্তে থাকে তামাভিত্তিক হিমোসায়ানিন নামক উপাদান, যা অক্সিজেন পরিবহনে সহায়তা করে এবং ঠান্ডা পানিতে তাদের টিকে থাকতে সাহায্য করে। এ বৈশিষ্ট্যগুলোই অক্টোপাসকে করেছে এক পরিবেশনির্ভর অভিযোজিত প্রাণী। প্রাণিজগতের এমন ব্যতিক্রমী প্রাণীদের সংরক্ষণ ও তাদের সম্পর্কে গবেষণা আমাদের পরিবেশের গভীরতর বোঝাপড়ায় সহায়ক হতে পারে।
লেখক : পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়