প্রকৃতির বিস্ময় আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে। তবে কিছু কিছু প্রাণী বা উদ্ভিদ আমাদের কল্পনারও বাইরে। এমনি এক অভূতপূর্ব উদ্ভিদ হলো র্যাফ্লেশিয়া আরনোল্ডি; যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একক ফুল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই ফুল শুধু আকারেই বড় নয়, এর আচরণ, জীবনচক্র এবং গন্ধ; সবই রহস্যময়।
আমরা জানি ফুল গাছে ফোটে। কিন্তু র্যাফ্লেশিয়া কোনো স্বাভাবিক গাছে ফোটে না। এটি পাতাবিহীন, শিকড়বিহীন, কাণ্ডবিহীন পরজীবী উদ্ভিদ, যার নিজস্ব কোনো সবুজ অংশই নেই! এটি নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখে, অন্য গাছের শরীরের ভিতর বাস করে; বিশেষ করে টেটরাস্টিগমা নামের এক ধরনের লতার মধ্যে।
বছরের পর বছর সেই লতার ভিতর নীরবে লুকিয়ে থাকে, যেন অদৃশ্য অস্তিত্ব। হঠাৎ কোনো একসময় তা মাটির ওপর ফুটে ওঠে, বিশাল এক লালচে-বাদামি রঙের পাঁচটি পাপড়ি মেলে ধরে এবং পুরো এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে দেয় পচা মাংসের মতো এক অদ্ভুত গন্ধ! এজন্য এর আরেক নাম ঈড়ৎঢ়ংব ঋষড়বিৎ বা লাশফুল।
র্যাফ্লেশিয়ার ফুল প্রায় ৩ ফুট ব্যাস এবং ৭ কেজি ওজন পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু এই বিশাল সৌন্দর্যের আয়ু মাত্র ৫ থেকে ৭ দিন। এর পরই পচে যায় ও হারিয়ে যায়, রেখে যায় বিস্ময়ের ছাপ।
এটি ফুল ফোটাতে ৯ থেকে ১০ মাস সময় নেয়। এত দীর্ঘ অপেক্ষার পর এমন স্বল্পস্থায়ী সৌন্দর্য যেন প্রকৃতিরই এক রকম খেয়াল। র্যাফ্লেশিয়ার গন্ধ মানুষকে ভ্রুকুটি করালেও কিছু মাছির জন্য এটি প্রেমের আহ্বান! এই গন্ধ লাশে বসা মাছিদের আকৃষ্ট করে। তারাই এই ফুলের পরাগ সংবহন ঘটায় ও নতুন র্যাফ্লেশিয়ার জন্ম দেয়।
বনের ধ্বংস, বাসস্থান সংকোচন, আর অবৈজ্ঞানিক পর্যটন এই বিরল ফুলটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আইইউসিএন ইতোমধ্যে এটিকে হুমকির মুখে পড়া প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এখনই কার্যকর সংরক্ষণ ব্যবস্থা না নিলে আমরা হয়তো ভবিষ্যতে আর কখনো এই বিস্ময়কর ফুলের দেখা পাব না।
র্যাফ্লেশিয়া শুধু একটি ফুল নয়, এটি জীববৈচিত্র্যের শক্তি, ধৈর্য ও ভারসাম্যের প্রতীক। এর অস্তিত্ব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান পৃথিবীর জন্য অপরিহার্য। আমাদের উচিত এমন সব অজানা ও বিপন্ন জীবের প্রতি কৌতূহল জাগিয়ে তোলা, তাদের জানার ও রক্ষার চেষ্টায় অংশ নেওয়া। কারণ প্রকৃতিকে রক্ষা মানেই আমাদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা।
লেখক : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়