ভূমিধস, নদীভাঙন, পাহাড় ধস কিংবা উঁচু রাস্তার পাশের মাটি ধসে যাওয়া বাংলাদেশের চিরচেনা দুর্যোগ। প্রতিবছর এসব কারণে প্রচুর মানুষ প্রাণ হারায়, সম্পদহানি হয়, হাজার হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। পাকা বাঁধ, প্রতিরক্ষা দেয়ালের নামে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও পিছু ছাড়ছে না এসব দুর্যোগ। অথচ প্রাকৃতিকভাবেই এসব সমস্যা মোকাবিলার এক কার্যকর ও সাশ্রয়ী সমাধান হতে পারে ভেটিভার বা বিন্না ঘাস। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু এই ঘাস লাগিয়েই দীর্ঘমেয়াদে ভূমিধস ঠেকানো সম্ভব। এজন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজনও নেই।
কী এই ভেটিভার : ভেটিভার (ঠবঃরাবৎরধ ুরুধহরড়রফবং), বাংলায় যা বিন্না ঘাস নামে পরিচিত, মূলত একটি বহু বর্ষজীবী ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর শিকড় ১০ থেকে ১৪ ফুট পর্যন্ত মাটির গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং এক জায়গাতেই লম্বভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে মাটির স্থায়িত্ব বাড়ে এবং ধস বা ভাঙন প্রতিরোধে চমৎকারভাবে কাজ করে। এই ঘাস দেখতে সাধারণ হলেও এর ক্ষমতা অসাধারণ। এর শিকড় শুধু মাটিকে আঁকড়ে ধরেই রাখে না, বরং ভূমির স্তরগুলোকে একটি প্রাকৃতিক জালের মতো ধরে রাখে, যা মাটির ক্ষয় রোধে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভেটিভারের সাফল্য : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভেটিভার ঘাস ভূমি রক্ষা এবং পরিবেশ পুনর্বাসনে ব্যবহৃত হচ্ছে। থাইল্যান্ড, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ব্রাজিল, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকান দেশগুলোতে এই ঘাস ভূমিধস রোধ, রাস্তার স্লোপ সুরক্ষা, নদীতীর সংরক্ষণ ও কৃষি জমি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপির বিভিন্ন প্রকল্পেও ভেটিভার ঘাসকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে পরিবেশবান্ধব সমাধান হিসেবে। থাইল্যান্ডে পুরো একটি ‘ভেটিভার ন্যাশনাল প্রোগ্রাম’ পরিচালিত হয় রাজপরিবারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়।
বাংলাদেশে ভেটিভারের সম্ভাবনা : বাংলাদেশে বিশেষত চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, কক্সবাজারের পাহাড়ি অঞ্চল এবং পদ্মা, যমুনা, মেঘনা নদীতীরবর্তী এলাকা ধস ও ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকে বছরজুড়েই। বিন্না ঘাস এসব সমস্যা মোকাবিলায় একটি টেকসই, স্বল্পব্যয়ী ও প্রাকৃতিক সমাধান হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। এ ছাড়া বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামের জরিপে দেশের অনেক জেলায় এ ঘাসের সন্ধান মিলেছে। বাংলাদেশে পাওয়া প্রজাতিটির বৈজ্ঞানিক নাম ভেটিভারিয়া জাইজানিওডিস। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশে যেসব প্রকল্পে এই ঘাস ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর বেশির ভাগই তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে যারা ভেটিভার ঘাসটি নিয়ে গবেষণা করছেন বা এর পক্ষে বলছেন, তাদের ধারণা- সারা বিশ্বে ঘাসটি সফলতা দেখাতে পারলেও অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশে ভালো ফলাফল করছে না। ভাঙন ও ভূমিধস প্রতিরোধের নামে বিভিন্ন প্রকল্পের লুটপাট জারি রাখতেই বিন্না ঘাসটিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই গত সাত-আট বছর ধরে ‘চেষ্টা’ করেও বিন্না ঘাসের কার্যকর ব্যবহারে সফলতা আসেনি।
ভেটিভার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম। ভেটিভার নিয়ে তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন। তিনি জানান, স্থানীয় ভাষায় এটাকে ‘খসখস’ও বলা হয়। চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে মাটিতে বোনা ঘাস ঢাল রক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। হিম ঠান্ডা কিংবা খরতাপ-সব পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এ ঘাসের। মাইনাস ৪০ থেকে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও বেঁচে থাকতে পারে। আবার অনাবৃষ্টিতে নেতিয়ে পড়ে না, পানিতে ডুবে থাকলেও পচে যায় না। লবণাক্ততায় টিকে থাকতে পারে বলে সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় বাঁধ রক্ষায় ভেটিভার সহজেই ব্যবহার করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এ ঘাসের একটা শিকড়ের সহনশক্তি ইস্পাতের ছয় ভাগের এক ভাগ! অর্থাৎ ছয়টা শিকড় একসঙ্গে করলে এটি ইস্পাতের মতোই শক্তিশালী।
এদিকে শুধু ভূমিধস রোধই নয়, প্রশাধনী ও ঔষধি গাছ হিসেবেও বিন্না ঘাসের বহুল ব্যবহার রয়েছে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশাহ নামদার’ বইতে খসখসের শরবত পানের উল্লেখ আছে। জনপ্রিয় পানীয় রুহ আফজার একটি উপাদানও বিন্না ঘাস। ভেটিভারের নির্যাসযুক্ত চা পান করে অনেক দেশের মানুষ। ভারতে ব্যবহৃত হয় ঘর ঠান্ডা রাখার উদ্দেশ্যে। বিন্না ঘাস থেকে তৈরি হয় মূল্যবান এসেনসিয়াল অয়েল। সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কিছু তেলের মধ্যে এই গাছের শেকড় দেওয়া হয়। ভেটিভারের শিকড় দিয়ে মাদুর বানিয়ে গ্রীষ্মকালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সদর দরজায়। নিয়মিত বিরতিতে পানি ছিটিয়ে মাদুরটি ভিজিয়ে রাখা হয়। বাতাস বইলে ঘর তো ঠাণ্ডা হয়ই, সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সুগন্ধ। এর গন্ধ তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় দামি পারফিউমের উপাদান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া ভেটিভার কাগজ ও পার্টিক্যাল বোর্ড তৈরির কাঁচামাল। এর শক্ত শিকড় দড়ি, টুপি, ঝুড়ি, মাদুর, চেয়ারেও লাগে। আবার জৈব সার তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। বিন্না ঘাস একদিকে যেমন গবাদি পশুর খাদ্য, আবার এর পাতা দিয়ে জুতা, ব্যাগ, ঘরের চালা, ট্রে, কুশন ও বালিশের কভার, বিছানার চাদর, শৌখিন কার্ড, টেবিলের রানারসহ অনেক আকর্ষণীয় হস্তশিল্প বানানো হয় বাণিজ্যিকভাবে। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশ ভেটিভার দিয়ে বানানো সামগ্রী রপ্তানিও করছে। গবেষকরা বলছেন, ভেটিভার ঘাস চাষে রাসায়নিক সার বা কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। এটি খুব অল্প পানিতেই টিকে থাকতে পারে এবং একবার লাগালে বছরের পর বছর মাটি আঁকড়ে রাখতে সক্ষম হয়। তবে শুধু রোপণ করলেই হবে না, প্রথম ছয় মাস যত্নের সঙ্গে পরিচর্যা করতে হয়। এরপর ভেটিভার নিজেই নিজের যত্ন করে। সরকারিভাবে পরিকল্পিতভাবে ভেটিভার চাষ, গবেষণা এবং পরীক্ষামূলকভাবে ভাঙনপ্রবণ এলাকায় প্রয়োগ শুরু করা উচিত। পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন ধারায় ভেটিভার হতে পারে এক যুগান্তকারী সমাধান।