মানুষের ইতিহাস আসলে খাদ্যের ইতিহাস। যখন মানুষ প্রথম বুঝতে শুরু করল ক্ষুধা কী, তখন থেকেই শুরু হলো তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম। প্রথমে সে বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে ফলমূল সংগ্রহের আশায়। তারপর শিকার শিখেছে, আগুনে রান্না শিখেছে। অনেক পরে, অনেক হাজার বছর পরে, মাটিতে হাত দিয়েছে বীজ বপনের জন্য। তখনই কৃষির জন্ম। পৃথিবীর ইতিহাসে কৃষিবিপ্লব মানুষকে টিকিয়ে রেখেছে সভ্যতার পথে।
মাঠের পর মাঠ মানুষ চাষ করেছে ধান, গম, শাকসবজি, ফলফলাদি। বন্যপ্রাণীকে বশে এনে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি পালন করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কখন মানুষ ভেবেছিল যে প্রকৃতির নদী-খাল-হ্রদের মাছেই আর নির্ভর করা যাবে না, নিজেই মাছ চাষ করতে হবে? সেই চিন্তার শুরু কোথায়, কে প্রথম সেই ভাবনার বীজ বপন করেছিলেন?
ইতিহাস বলে, প্রায় ৩ থেকে ৬ হাজার বছর আগে মানুষ শিখেছিল মাছ চাষের প্রাথমিক কৌশল। তবে তার লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর মাছ চাষ ইতিহাসে প্রথম প্রমাণটি পাওয়া যায় চীনে। চীনারা হাজার হাজার বছর আগে যেভাবে জ্ঞানকে সংরক্ষণ করেছেন, তাতে অবাক হতে হয়। মাছ চাষের ওপর আড়াই হাজার বছর আগের একটি বই আজও রয়েছে সাংহাইয়ের সুজু শহরে। বইটির নাম ‘দ্য ক্লাসিক অব ফিশ কালচার’। লেখক ফ্যান লি, প্রাচীন চীনের এক দার্শনিক, রাজনীতিক ও উদ্যোক্তা। বছর দুই আগে, চীনের আন্তর্জাতিক কৃষি যন্ত্রপাতি মেলায় অংশ নিতে হুবেই প্রদেশের উহান শহরে গিয়েছিলাম। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির এমন এক মেলা, যেখানে বিশ্বের প্রায় সব বড় কোম্পানিই হাজির ছিল নিজেদের উদ্ভাবন নিয়ে। কিন্তু মেলা শেষে আমার মাথায় ঘুরছিল অন্য চিন্তা, সেই ফ্যান লির কথা, যিনি নাকি পৃথিবীর প্রথম মাছ চাষি। ভাবলাম, সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। মেলা শেষে ছুটে চললাম সুজুর দিকে, ফ্যান লির সন্ধানে। সঙ্গে ছিলেন সহকর্মী তানভীর আশিক ও রাসেল শাহ। উহান থেকে বুলেট ট্রেনে যাত্রা শুরু হলো। জানালার বাইরে ছুটে চলা চীনের সবুজ প্রান্তর যেন অতীতের এক ইতিহাসকেই সামনে এনে রাখছিল।
সুজু পৌঁছাতেই অভ্যর্থনা জানালেন স্থানীয় কৃষি উদ্যোক্তা টাইগার। মজার নাম, প্রাণবন্ত মানুষ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া আমাদের বন্ধু ফেরদৌস মুরাদ, যিনি চীনের মাছ চাষ প্রযুক্তির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। গাড়িতে করে যেতে যেতে টাইগার বলছিলেন ফ্যান লির গল্প। তিনি জানালেন, ফ্যান লি শুধু মাছ চাষই করতেন না, বরং তিনি রাষ্ট্রীয় মন্ত্রীও ছিলেন, চৌ রাজবংশের উয়ে রাজ্যের অধীনে। রাজনীতিক ফ্যান লি, কিন্তু পেশায় এক দূরদর্শী উদ্ভাবক। তাঁর বইটি শুধু মাছ পালনের কৌশল নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ ইকোসিস্টেম তৈরির নির্দেশনা। টাইগার গল্প বলছিলেন প্রাচীন কালের মতো করেই। সেই রাজ্যে একদিন রাজা দেখলেন, তাঁর মন্ত্রী ফ্যান লি খুব বিলাসী জীবনযাপন করছেন। রাজার সন্দেহ হলো, মন্ত্রী হিসেবে যে বেতন পান, তাতে এমন জাঁকজমক সম্ভব নয়। রাজা একদিন ফ্যান লিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এত সম্পদের উৎস কোথায়?
ফ্যান লি উত্তর দিলেন, ‘মাছ চাষ থেকেই, মহারাজ।’
রাজা বিস্মিত। ফ্যান লি তখন রাজাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বললেন, ‘বড় পুকুরে ছোট ছোট দ্বীপ তৈরি করতে হবে, যেন মাছগুলো মনে করে তারা কোনো প্রাকৃতিক হ্রদে আছে। এতে তারা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে, চাপমুক্ত থাকবে। চীনের চন্দ্র ক্যালেন্ডারে চার চাঁদের মধ্যেই তারা খাওয়ার উপযুক্ত আকারে পৌঁছে যাবে।’ ভাবলে অবাক লাগে, আজকের আধুনিক ‘ইকোলজিক্যাল ফিশ ফার্মিং’ ধারণা যেখানে মেশিন, অ্যারেটর আর জৈব নিয়ন্ত্রণে চলে, সেখানে আড়াই হাজার বছর আগে একজন মানুষ প্রকৃতির ছন্দ অনুসরণ করে একই কথা লিখে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছালাম উশিতে অবস্থিত চীনের ফ্রেশওয়াটার ফিশ রিসার্চ সেন্টারে। এখানেই নাকি সংরক্ষিত আছে ফ্যান লির সেই বিখ্যাত বইয়ের স্মারক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দিনটি ছিল রবিবার, কেন্দ্রটি বন্ধ। তবু অধ্যাপক মা, একজন সিনিয়র গবেষক, আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। মনে হচ্ছিল, নিশ্চয়ই কোনো বিশাল প্রাচীন লাইব্রেরিতে বইটি রক্ষিত আছে। হয়তো পুরোনো প্যাপিরাস বা বাঁশের পাতায় লেখা। কিন্তু না, অধ্যাপক মা আমাদের নিয়ে গেলেন এক খোলা প্রান্তরে, যেখানে এক পাশে বড় জলাধার, আর তার সামনে বিশাল পাথরের দেয়ালে খোদাই করা পুঁথির আকৃতি। সেখানে চীনা ও ইংরেজি ভাষায় লেখা রয়েছে ফ্যান লির চিন্তাধারা, কীভাবে মানুষ পুকুরে দ্বীপ তৈরি করে মাছের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
তিনি বললেন, ‘বইটির কোনো আসল কপি আর নেই। কিন্তু ধারণাটি অমর হয়ে আছে। এই দেয়াল তার স্মারক।’
দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিলাম, দেয়ালের ওপরে বিকালের সূর্যের আলো পড়ে ঝিলমিল করছে। পাশে সারিবদ্ধ ছোট ছোট গবেষণা পুকুর। সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, খাদ্য ও পানির গুণমান নিয়ে চলছে গবেষণা। তরুণ গবেষকরা ব্যস্ত নোট নিচ্ছেন, ছোট জাল ফেলে মাছ তুলছেন। মনে হচ্ছিল, এই মাঠেই যেন আড়াই হাজার বছর আগে ফ্যান লি প্রথম জাল ফেলেছিলেন, প্রথম ভেবেছিলেন, ‘মাছও মানুষ চাষ করতে পারে।’ চীনে মাছ চাষ আজ এক শিল্প। প্রতি বছর কোটি কোটি টন মাছ উৎপাদন হয় এখান থেকে। কিন্তু এই শিল্পের শিকড় সেই ফ্যান লির হাতে। তাঁর চিন্তা ছিল প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে মাছ চাষ করা এমন এক ধারণা, যা আজকের ‘সাসটেইনেবল অ্যাকুয়াকালচার’-এর মূল দর্শন।
ভাবতে অবাক লাগে, তিনি যখন বলেছিলেন- ‘মাছকে প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হতে দিতে হবে,’ তখন পৃথিবীতে বিজ্ঞান, মাইক্রোস্কোপ বা জীবরসায়নের কোনো নামই ছিল না। অথচ তাঁর পরামর্শ আজও সত্য, আজও প্রাসঙ্গিক।
ভাবছিলাম, কী অদ্ভুতভাবে ইতিহাস ঘুরে ফিরে আসে। মনে পড়ল, আশির দশকের প্রথম দিকে যখন বাংলাদেশের প্রথম দিকের মাছ চাষ প্রকল্পগুলোর চিত্র ধারণ করছিলাম, তখন নোয়াখালীর ফেনীতে এক সরকারি হ্যাচারিতে দেখেছিলাম কয়েকজন চৈনিক বিশেষজ্ঞ মাঠকর্মীদের মাছ চাষ শেখাচ্ছেন। তারা জাল টানছিলেন, পানির গুণমান মাপছিলেন; তখনো আমরা জানতাম না, এই জ্ঞানের শিকড় কত গভীর, কত প্রাচীন। ফ্যান লির নাম হয়তো ইতিহাসের বড় বড় বইয়ে আলাদা করে লেখা নেই। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন এক চিন্তার স্রোত। তাঁর জীবনের গল্প শুধু মাছ চাষের নয়, আত্মোন্নয়ন ও দায়িত্ববোধের গল্পও। বলা হয়, তিনি রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসায় নামেন। আবার পরবর্তী জীবনে সব ছেড়ে যান নিঃসঙ্গ জীবনে। চীনারা তাঁকে এখনো স্মরণ করে ‘প্রজ্ঞাবান বৃদ্ধ’ নামে। পৃথিবী এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন বাস্তবতায়। পানির উৎস কমছে, নদী মরে যাচ্ছে, মৎস্যসম্পদ হুমকির মুখে। এই সময়ে টেকসই মাছ চাষ কেবল অর্থনৈতিক প্রয়োজন নয়, বরং একটি পরিবেশকেন্দ্রিক দায়িত্ব। বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ মাছ উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু সামনে চ্যালেঞ্জ বাড়বে। উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে যেন প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট না করি, সেই শিক্ষাটিই ফ্যান লির কাছ থেকে নেওয়া দরকার।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব