ভ্রাতুষ্পুত্রীর বৈবাহিক সূত্রে আমার দুই আত্মীয় এসেছেন ঘরে। এঁরা বিলকুল তাজা সম্পর্কিত। তাই, মাথায় এলো : তাজা রূপচান্দা খাইয়ে অতিথির মুগ্ধতা আদায় করতে হবে। সন্ধ্যা নামে নামে সময়ে মাছবাজারে ঢুকতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকার চিরে সম্মিলিত আওয়াজ ওঠে- ‘গেছে ... রে... গেছে।’ শব্দের মধ্যে মৃদু ফুর্তির সুর। তবে খিস্তিও বাদ যায়নি। কুপিবাতি ধরানোয় সচেষ্ট মাঝ বয়েসি এক বিক্রেতা তাঁর পাশের যুবক বিক্রেতার উদ্দেশে বলেন, ‘ডেসকোর খাটাসগুলানরে হাত-পাও বাইন্দা বুড়িগঙ্গায় ফিক্কা না মারলে এই আন্দার/এই রোশনাই খেলা আর থামবে নারে বাপ।’
বিক্রেতাদের জ্বালানো কুপিবাতির আলোয় বিকিকিনি চলছিল। পছন্দের রূপচান্দা কিনে স্বস্তি পেলাম। অতিথিরা খেয়ে তৃপ্ত। সমস্যায় পড়েছি তিন দিন পরে। বাজারের আলো/ আঁধারি বাতাবরণে রূপচান্দা বিক্রেতা ‘ফেরত প্রাপ্য’ হিসেবে আমায় যে সাত শ টাকা দেন তার মধ্যে এক শ টাকার দুইখানা নোট। প্রতিটি নোট চার টুকরো, তবে স্কচটেপ দিয়ে চমৎকার জোড়া দেওয়া। টাকাগুলো তিন দিন ধরে তোশকের নিচে। ওরা সেখান থেকে বের হয়ে গৃহকর্ত্রীর কণ্ঠস্বর জোরদার করল। তোমার ইতিহাস, রাতের বেলায় বাজারে গিয়ে দুনিয়ার যত অচল নোট আছে, সবগুলো সংগ্রহ করে ঘরে নিয়ে আসার ইতিহাস। (সংসার জীবনের) এই এত বছরেও তোমার আক্কেল হলো না। যতই বলি রাতে মাছবাজারে যাওয়ার দরকার নেই, ততই তোমার জেদ, যাবেই যাবে। এখন, যাও গুলিস্তানে। পঁচিশ পার্সেন্ট বাট্টা দিয়ে, দুই শ টাকার বিনিময়ে দেড় শ টাকা পেয়ে ধন্য হও।
স্কুলগামী পুত্রটিও মায়ের পক্ষাবলম্বন করেছে। তার যুক্তি গেস্টরা তো দুদিন বেড়িয়ে গেলেন। তাঁদের জন্য সকালে রূপচান্দা কেনার সুযোগ ছিল। মুরগির গোশত ছিল, পোলাও করা হয়েছে, খাসির গোশতও খাওয়ানো হয়েছে। রাত কাটিয়ে সকালে রূপচান্দা কিনলে তোমায় ওরা অচল নোট গছিয়ে দিতে পারত? খুবই ন্যায্য কথা! পুত্রের সঙ্গে সহমত হলাম। কিন্তু গৃহকর্ত্রী বলেন, অচল নোট নেওয়ার জন্য যে মুখিয়ে থাকে তার জন্য দিন যা, রাতও তাই। চব্বিশ ঘণ্টা চোখে পাওয়ার গ্লাস, তবু যারা ছেঁড়া নোট চেনে না তাদের পক্ষে হরিণ ভেবে চিতাবাঘকে কোলে তুলে নেওয়ার মারাত্মক চেষ্টা অস্বাভাবিক নয়।
গৃহস্বামীর প্রেস্টিজ অ্যাট স্টেক হয়ে পড়েছে। সংকটের পেছনে যে মাছ বিক্রেতার অবদান তাকে গিয়ে বলা যায়, বদলে দাও নোট। কিন্তু তার চেহারা যে মনে পড়ছে না। কী যে করি! এমন ভাবছি আর অমনি হাজির তালতো ভাই লিয়াকত হোসেন। তাওই সাহেবের পুত্রকে আমাদের এলাকায় বলা হয় তালতো ভাই। লিয়াকত পেশায় অ্যাডভোকেট। তবে ‘সমাজসেবার’ বাতিক আছে। তা আছে যখন থাকুক না। চোখের সামনে কতজনকেই তো সাধক হয়ে যেতে দেখলাম। সমস্যা হলো, তালতো ভাইটি মনে করে আমি তার সাধনার মদতদাতা এবং নিবন্ধের খসড়া ঘষামাজা করার জন্য করে অবিরাম ঘ্যানর ঘ্যানর।
লিয়াকতের আজকের নিবন্ধের বিষয় ‘রাজধানীতে পঁচিশ টাকায় পুষ্টিকর দ্রব্য দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ করার উপায়।’ ৯০০ শব্দের রচনা। লেখকের পরিচয় দিয়েছে-‘আইনজ্ঞ, নিবন্ধকার ও চিন্তক।’ আজকাল বেশ কজন বক্তাকে (দুনিয়ার সব বিষয়ের ওপর এরা মন্তব্য করবেনই) সংবাদপত্রের প্রতিবেদকরা ‘চিন্তক’ বলে উল্লেখ করেন। চিন্তা করা যায়! লিয়াকত নিজেকে চিন্তক বলেছে ২০০৪ সালে।
চিন্তক মানে? জবাবে লিয়াকত বলে, ‘মাই গড। সিম্পল শব্দটার মানে জানেন না। যিনি চিন্তা করেন তিনিই চিন্তক।’ তাকে বলি মানুষ মাত্রই চিন্তক। এতে বিশেষ হওয়ার চেষ্টা কেন? যিনি নিজেকে চিন্তক বলে জাহির করছেন তিনি হয়তো ধরে নিয়েছেন, তিনি বিনা কারও মাথায় ঘিলু নেই। সব চিন্তা তাকেই করতে হবে। পরের হয়ে চিন্তা করবার বিপুল ভার কাঁধে নিয়ে কেন তিনি চ্যাপ্টা হতে চাইছেন?
‘তওবা। তওবা। ক্ষ্যামা দিলাম।’ এই বলে লিয়াকত বলপেন দিয়ে চিন্তক কথাটি কেটে দিল। এ সময় তাকে আমার নোট সমস্যা জানাই। তার পরামর্শের ভিত্তিতে মাঠে নেমে পড়লাম।
২.
কাউকে বিশেষ করার চেষ্টা, লিয়াকতের মতে, আমাদের বিষয় হয়ে ওঠে বিশেষ বিশেষ অবস্থায়। সে জানায়, তার কলেজ জীবনে গানবাজনার আসরে আমন্ত্রিত হয়ে যা দেখল আর শুনল তার জন্য ভাগ্য লাগে। অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হয়ে আসন গ্রহণ করতে গেল; বাধা দিলেন এক ভলান্টিয়ার। এখানে বসবেন না প্লিজ। পেছনে, চেয়ারের চতুর্থ সারিতে গিয়ে বসুন। লিয়াকত বলেন, এখানে বসব না কেন? ভলান্টিয়ারের জবাব, এখানে সিনিয়ররা বসবেন। লিয়াকত জানতে চায় সিনিয়র কারা? তাকে বলা হয়, যারা জুনিয়র নন, তারা। প্রশ্ন, জুনিয়র কারা? উত্তর, যারা সিনিয়র নন, তারা। তাহলে আমি কোন বৃক্ষের গোটা? বলে বিরক্ত অ্যাডভোকেট লিয়াকত, বলুন আমার পরিচয়টা কোথায়? ভলান্টিয়ার সহাস্যে বলেন, পরিচয় তো ভাইয়া আপনার ব্যবহারে। যেভাবে রেগে যাচ্ছেন তাতে মনে হয় নিজেকে জুনিয়র ভাবতে আপনার খুব পেইন হচ্ছে। নো গেইন উইদাউট পেইন। খসরু ভাই, খসরু ভাই...
ডাকেন আবার কারে? প্রশ্ন করে লিয়াকত। তাকে জানানো হয়, খসরুজ্জামান ভুঁইয়া হলেন এই ফাংশনের রিসেপশন কমিটির ইয়ে। কারে কোথায় বসাবেন সেই পাওয়ার ওনার হাতে। কমিটির সভাপতির পরই তার ইয়ে মানে পজিশন মানে খসরু ভাই হচ্ছেন কমিটির সেরকেটারি।
হাঁক দেওয়ার প্রায় ৩ মিনিট পর খসরু ভুঁইয়ার আগমন। তিনি বলেন, কি রে মোজা, কেস্ কী? দামড়ার লাহান চিক্করস ক্যান। মোজা (সম্ভবত মোজাম্মেল) বলেন, এই ভাইয়ার ব্যবহার গরম। জুনিয়র চেয়ারে বসতে চাইতেছেন না। মিঠা কথা অনেক কইলাম। তবু ভুঁরু দুইখান কুঁচকাইয়া রাখছেন তো রাখছেনই। খসরু বলেন, ‘ঠান্ডা মেজাজে কেস্্ ডিল করতে হয়। এসো ভাই, সমাধান করছি।’ সাদরে হাত ধরে লিয়াকতকে তৃতীয় সারির চেয়ারে নিয়ে বসিয়ে দেন খসরু। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু সংগীতানুষ্ঠান। মধুরকণ্ঠী এক নারী গাইছিলেন ‘ধরায় যখন দাওনা ধরা/হৃদয় তখন তোমায় ভরা/এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহিরে...।’ এ সময় হঠাৎ কোথা থেকে মোজা এসে কানে কানে লিয়াকতকে বলে : যে সারিতে বসে আছেন সেটা কিন্তু জুনিয়রদেরই ভাইয়া।
৩.
চার টুকরো অথচ স্কচটেপ দিয়ে জোড়া দেওয়া এক শ টাকার নোট দুখানা পকেটে নিয়ে পাঁচ দিন পর ফের বাজারে গেলাম। মাছ কিনতে হবে। মুরগি পিঁয়াজ রসুন আদা ভোজ্য তেল ডাল চিনি লবণ সবই লাগবে। সাধারণত প্রথমে কিনি মাছ-মাংস, এরপর অন্যান্য। কিন্তু আজ বুদ্ধিমান হয়েছি। প্রথমে অচল নোট শুদ্ধ করার চেষ্টায় মনোযোগী হলাম। সকাল ১০টা। বাজারে বেশ ভিড়। সপ্রতিভ ভঙ্গিতে উপস্থিত হলাম ‘জেনিথ স্টোর’ নামক মুদি দোকানে। ‘সালামুয়ালাইকুম’ বলে স্বাগত জানায় আক্কাস মানে শিহাবুদ্দিনের ভাগনে।
টেলিফোন শিল্প সংস্থার মাঝারি গোছের কর্মকর্তা পাবনা জেলার শিহাবুুদ্দিন। তিনি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়ার স্বপ্নে অনেক কষ্টেসৃষ্টে মুদি দোকানটি চালু করেছেন। তাঁর বড় বোনের ছেলে আক্কাস আহমেদ বিএসসি পাস করে উচ্চ বেতনের চাকুরে হওয়ার উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন। বিদেশযাত্রার স্বপ্ন দেখা আর দোকানে মামাকে হেলপ্্, দুটোই সমানে করছে আক্কাস। সে স্মার্ট, বিনয়ী; বড়ই মিষ্ট ব্যবহার তার। ছ’মাস ধরে ওর সঙ্গে আমার সংযোগ।
‘এ তুমি কী করলে আক্কাস?’ বললাম আমি, ‘কেনাকাটার পর যে টাকা ফেরত দাও, সরল মনে কোনো যাচাই না করে সে টাকা বাড়ি নিয়ে যাই। এই দেখ, কী দিয়েছ।’ নোট দুখানা ওর দিকে বাড়িয়ে দিই। আক্কাস বলে, ‘আমি দিয়েছি?’ নোট দুটি উল্টেপাল্টে দেখে সে। বলে, ‘কোন দিন দিয়েছি স্যার?’
বলি, ‘কালই তো দিলে।’ মুচকে হাসে আক্কাস, ‘কোনো সমস্যা না স্যার। এখনই বদলে দিচ্ছি।’ ক্যাশ বাক্স খুলে কড়কড়ে নতুন দুখানা এক শ টাকার নোট বের করে আমার হাতে দেয় আক্কাস, ‘ঠিক আছে স্যার?’ বললাম, ‘থ্যাংক ইউ।’ নিত্যপণ্যের তালিকাটা ওর হাতে দিয়ে মাছ-মাংস কিনতে রওনা দিই। ওগুলো কেনার পর মুদিমাল সংগ্রহ করব। মাছ-মুরগি কেনা শেষে রিকশায় চেপে জেনিথ স্টোরে এলাম। পিঁয়াজ রসুন আদা তেল চিনি ইত্যাদি রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে আক্কাস অতি মিষ্ট ভাষায় বলে, ‘একটা কথা বলব স্যার?’ মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলাম। আক্কাস আহমেদ তার মুখে অতি মোলায়েম হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘কাল কিন্তু আপনি বাজারে আসেননি স্যার।’ রসগোল্লা খাইয়ে নাকে ঘুষি মারা কী এরেই কয়?
৪.
আক্কাসের ব্যবহারের এই ঘটনা বলেছিলাম আলতাফ মাহমুদকে (সাংবাদিক নেতা; মৃত্যু : ২৪ জানুয়ারি ২০১৬)। শুনে তিনি এক ডাক্তারের অদ্ভুত ব্যবহারের বর্ণনা দেন। তার নাম ডা. ফুটনসন। রোসা নামে এক মহিলা থানায় লিখিত অভিযোগ করে : উষ্ঠা খেয়ে আমার ডান পায়ের নখ খসে যায়, খুব রক্তপাত হচ্ছিল। চিকিৎসার জন্য ডা. ফুটনসনের চেম্বারে যাই। সেখানে নার্স বলে, ‘স্যার পরীক্ষা করে দেখবেন। সব কাপড়চোপড় খুলে রেখে ওই চেয়ারে গিয়ে বসুন।’ বললাম, চোট লেগেছে পায়ের বুড়ো আঙুলে। ওই আঙুল দেখলেই তো হয়। সব কাপড়চোপড় খুলতে হবে কেন?
নার্স বলে, ‘এটা আমাদের চেম্বারের নীতি।’ রোসা বলেন, ‘হতে পারে নীতি। তবে খুবই জঘন্য।’ নার্স বলে, ‘জঘন্য বলা কি ঠিক হচ্ছে! ওই যে দেখছেন তিন ভদ্রলোক বসে আছেন। এদের একজনের নাকে চোট লেগেছে, আরেকজনের কানে জমেছে পুঁজ, আরেকজনের কবজি ফোলা। কই, তারা তো আপত্তি করেননি। তিনজনই দিগম্বর হয়ে রয়েছেন।’ ‘আমারও একই অবস্থা বোন।’ পাশের কামরা থেকে বলেন এক ব্যক্তি ‘এসেছিলাম এয়ারকুলার মেরামত করতে। রোগী ভেবে আমাকে জন্মদিনের পোশাক পরিয়েছে।’
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন