রাজস্ব আদায় বাড়ানো ও কর ফাঁকি রোধে সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যভান্ডার একীভূত করতে একটি বড় ধরনের ডিজিটাল রূপান্তরের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। এর মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পেমেন্ট গেটওয়ে, বেসরকারি খাতের ইআরপি (এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং), বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), পরিকল্পনা কমিশন, সরকারি ক্রয় কর্তৃপক্ষ এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তরকেও এই নেটওয়ার্কে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে প্রয়োজনভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে ‘স্ট্রেনদেনিং ইনস্টিটিউশনস ফর ট্রান্সপারেন্সি অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি (সিটা)’ প্রকল্পের অধীনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তথ্য একীভূতকরণ ও জাতীয় ডেটা গভর্ন্যান্স অথরিটি গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন। তাতে বলা হয়, সরকারি সব সফটওয়্যার দেশীয় উৎস থেকে ক্রয় করতে হবে, সরকারের মালিকানায় সোর্স কোড সংরক্ষণ করতে হবে এবং আপগ্রেড বা রক্ষণাবেক্ষণে বিদেশি বিক্রেতার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ডিজিটাল রূপান্তর প্রকল্পটি তিন ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম ধাপে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার বিদ্যমান সফটওয়্যার সিস্টেমের মধ্যে আন্তঃসংযোগ (ইন্টারঅপারেবিলিটি) তৈরি করা হবে, যাতে নির্বিঘ্নে ডেটা বিনিময় করা যায়।
তারা বলেন, বিভিন্ন সংস্থার আইটি সিস্টেমে ভিন্ন ভিন্ন প্রটোকল ব্যবহৃত হওয়ায় তথ্য ভাগাভাগি করা কঠিন। সেক্টরভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) ও মিডলওয়্যার ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ ডেটা বিনিময় মানদণ্ড তৈরি হবে। বিশেষ সহকারীর ধারণাপত্রে বলা হয়, সিটা ফ্রেমওয়ার্ক এবং বিবিএস ও এনবিআরের সফটওয়্যারগুলোর মালিকানা আলাদা হলেও ব্যাকএন্ড ও মিডলওয়্যারে সাধারণ প্রটোকল ব্যবহারের ফলে মানসম্মত ও নিরাপদ ডেটা বিনিময় সম্ভব হবে। দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা হবে জাতীয় ডেটা গভর্ন্যান্স ও ইন্টারঅপারেবিলিটি অথরিটি, যা সব মন্ত্রণালয়ের মূল ডেটাবেস সংযুক্ত একটি জাতীয় ডেটা এক্সচেঞ্জ সিস্টেম তত্ত্বাবধান করবে। এই কর্তৃপক্ষ একটি লাইসেন্সমুক্ত, ভেন্ডরনিউট্রাল প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা করবে এবং সব সোর্স কোড কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করবে। তৃতীয় ধাপে এই ডেটা সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও মেশিন লার্নিং (এমএল) প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে সহায়তা করা হবে।
বিশেষ সহকারীর ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, এনবিআরের সিস্টেমকে জাতীয় পেমেন্ট গেটওয়ে, এনপিএসবি, আরটিজিএস, বিইএফটিএন, একপে, গুগল পে ও এসএসএলের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে ইন্টারঅপারেবল করতে হবে, যাতে গেটওয়ের মাধ্যমেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ই-ইনভয়েস তৈরি করা যায়। এনবিআরকে স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ইআরপি সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত করলে কর, ভ্যাট ও লেনদেন-সংক্রান্ত তথ্য সরাসরি রাজস্ব বোর্ডের ডাটাবেসে সংরক্ষিত হবে। উৎসে কর কর্তনের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ইটিডিএস ব্যবস্থার মাধ্যমে কোম্পানি কর সরাসরি ব্যবসায়িক ইআরপি সফটওয়্যার থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে বলে ধারণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। তৈয়ব আরও প্রস্তাব করেছেন, প্রতিটি সেক্টরাল ডেটা এক্সচেঞ্জে মাইক্রো সার্ভিসভিত্তিক এআই ব্যবহার করা হবে; যা সন্দেহজনক লেনদেন বা সম্পদ পরিবর্তনের তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে সতর্ক করবে। গাড়ি বা জমি কেনাবেচার মতো সম্পদ পরিবর্তনের তথ্য এনবিআর তাৎক্ষণিকভাবে পাবে, আর বিএফআইইউ ও দুদক পাবে সন্দেহজনক লেনদেনের রিয়েলটাইম সতর্কতা। এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাজস্ব আহরণে সক্ষমতা না বাড়াতে পারায় বাংলাদেশ নিম্ন বাজেট প্রণয়ন ও দুর্বল বাস্তবায়নের চক্রে আটকে আছে। ব্যাংক, পেমেন্ট গেটওয়ে ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকে একীভূত করলে কর আদায় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে এবং স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় দুর্নীতিও কমবে।