তিস্তা নদীর পানি গতকাল থেকে নামতে শুরু করেছে। তবে এখনো বিভিন্ন স্থানে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। কোথাও কোথাও নদী ভাঙনের হুমকিও তৈরি হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
নীলফামারী : তিস্তায় পানি নামতে শুরু করেছে। গতকাল সকাল ৯টায় ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহের উচ্চতা রেকর্ড করা হয়েছে ৫২ দশমিক ১২ সেন্টিমিটার (বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার)। এর আগে রবিবার রাত ১১টায় পানিপ্রবাহ ৫২ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার অর্থাৎ বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তবে পানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যারাজের ৪৪টি গেট এখনো খুলে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয়রা জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢল আর কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে তিস্তার পানি প্রবাহ বাড়তে থাকে। ফলে চরাঞ্চল ও বাম তীরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে হাজারো পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ডুবে যায় কৃষকের ফসল, ভেসে যায় পুকুরের মাছ। এখন তিস্তার পানি প্রবাহ কমতে থাকায় নতুন করে নদী ভাঙনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের আবুল হোসেন ও হুমায়ুন রশিদ বলেন, তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে কমতে শুরু করলে ভাঙন দেখা দিয়ে থাকে। আগের রাতে পানি ঘরবাড়িতে ঢুকেছিল, গতকাল থেকে সে পানি নেমে যেতে শুরু করেছে। এখন ভাঙনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম বলেন, গত রবিবার সন্ধ্যা থেকে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করে। রাত ১১টায় পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গতকাল সকালে পানি বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। আর পানি বাড়ার সম্ভাবনা নেই। নিম্নাঞ্চলের পানি নামতে শুরু করেছে।
লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে পানিবন্দি হয়ে আছেন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে চলছে বোবা কান্না। সরকারিভাবে যে পরিমাণ সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়েছে তা তুলনায় অতি নগণ্য। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটছে বানভাসি মানুষের। তবে জেলা প্রশাসক রকিব হায়দার বলেন, ত্রাণের কোনো অভাব নেই। প্রত্যেক বানভাসি মানুষই ত্রাণের আওতায় আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তা অববাহিকার ৫টি উপজেলায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এদিকে আদিতমারী উপজেলার সোলেডি স্পার বাঁধ-২ এর ব্রিজ অংশের নিচে সুড়ঙ্গ হয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বাঁধটি ধসে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হাতীবান্ধার দোয়ানী-গড্ডিমারী সড়ক উপচে নতুন নতুন এলাকায় ঢুকে পড়েছে বন্যার পানি। সিন্দুর্না এলাকার রইচ উদ্দিন বলেন, ‘বাড়ির উঠানে কোমর পানি। রাতে ঘুমাতে পারিনি। শিশুদের কোলে নিয়ে রাত কাটাতে হয়েছে। কখন কোন সন্তান বিছানা থেকে পড়ে পানিতে ডুবে যায়- সে আতঙ্কে রাত কেটেছে।’ গোবর্ধন গ্রামের ছকমল মিয়া বলেন, ‘সবখানে পানি আর পানি। মধ্যবয়সি আমন ধানের খেতসহ ফসল ডুবে নষ্ট হচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে মাছ।’
রংপুর : গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে আছে। এখানে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে ৫ হাজারের বেশি পরিবার। গতকাল দুপুরের দিকে কাউনিয়ার তিস্তা রেল সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এতে কাউনিয়ার ঢুষমারা, তালুক শাহবাজ, পূর্ব নিজপাড়ার অংশ, গোপীডাঙ্গা, আরাজি হরিশ্বর, চর প্রাণনাথ, বিশ্বনাথ, হরিচরণ শর্মা, হয়বত খাঁ গ্রামের ৩ শতাধিক পরিবারের বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়াও আমন ধানের খেত, সবজি খেত পানিতে ডুবে গেছে। বেশ কিছু পুকুর ও মাছের খামারের মাছ পানির তোড়ে ভেসে গেছে। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাঙনও দেখা দিয়েছে।
কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহিদুল হক গতকাল দুপুরে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে বলেন, বালাপাড়া ও টেপামধুপুর ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী কয়েকটি গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। এদিকে গঙ্গাচড়া উপজেলার গঙ্গাচড়া, লক্ষ্মীটারী, গজঘণ্টা, মর্নেয়া, নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ ইউনিয়নের তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে নদীর পানি ঢুকেছে। হাঁটু সমান পানিতে তলিয়ে গেছে অনেকের ঘরবাড়ি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদ হাসান মৃধা জানান, সাম্প্রতিক বন্যায় তিস্তার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে বন্যাকবলিত এলাকায় শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদী পাড়ে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে উঠতি আমন খেতসহ বিভিন্ন ফসলি জমি ও বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে উপজেলা কাপাসিয়া ইউনিয়নের উত্তর লালচামার গ্রামে ২০টি বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলিন হয়েছে। ৫০টি বসতবাড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ২০০টি বসতবাড়ি ভাঙনের মুখে রয়েছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ৯টায় উপজেলার সীমান্তবর্তী কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদী বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলার ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও তা বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার রাশিদুল কবির জানান, কাপাসিয়া শ্রীপুর, চণ্ডীপুর ও হরিপুর ইউনিয়নের কয়েকটি চরে তিস্তার ভাঙনে আমন খেতসহ অন্যান্য ফসলি জমি নদীতে বিলীন হচ্ছে। এতে কৃষকদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওয়ালিফ মণ্ডল জানান, কাপাসিয়া ইউনিয়নের কয়েকটি চরে নদীভাঙন শুরু হয়েছে। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়েছে। চেয়ারম্যানকে ভাঙনকবলিত পরিবারের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, ‘ওই এলাকার ২১০০ মিটার জায়গা ওপেন আছে। সেখানেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনকবলিত এলাকায় জিওব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধে সমীক্ষা করা হয়েছে। বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু করা হবে।