হিজরি সনের ১২ রবিউল আউয়ালকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন হিসেবে পালন করা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে দিনটি বিশেষ গুরুত্বের চোখে দেখা হয়। এদিন দেশজুড়ে বের হয় ঈদে মিলাদুন্নবীর বর্ণাঢ্য মিছিল। মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল-কলেজে রসুল (সা.)-বিষয়ক আলোচনা সভা বা মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। মুহাম্মদ (সা.)-এর জমানায় জন্মদিন পালনের কোনো রীতি ছিল না আরব দেশে। এমনকি এখনো সৌদি আরব কিংবা অন্য আরব দেশে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন পালিত হয় না। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় কিংবা তাঁর পরের শতবছরের কোনো ইতিহাস বা জীবনীগ্রন্থে ১২ রবিউল আউয়াল যে মহানবীর জন্মদিন এমন কোনো তথ্য নেই। আল কোরআনেও তাঁর জন্মদিন প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি। এমনকি কোনো হাদিসে ১২ রবিউল আউয়াল যে মহাপুরুষ মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন সে তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন হাদিসে রয়েছে রসুল (সা.) সোমবার দিন রোজা রাখতেন জন্মবার হিসেবে। মহানবী (সা.) কবে জন্মগ্রহণ করেন সেটি মোটেও প্রাসঙ্গিক নয়। তিনি যে উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, মানবজাতির মুক্তির জন্য তিনি যে অবদান রেখেছেন, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
দুই. সর্বকালের সেরা মানব হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে। নানা ধর্মের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিধর্মী ইতিহাসবিদরাও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নকে বলা হয় মহাপণ্ডিতদের একজন। জন্মসূত্রে তিনি ব্রাহ্মণ। পরবর্তী সময়ে বস্তুবাদী দর্শনের দীক্ষা গ্রহণ করেন। কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনের পথ ধরে সমাজ পরিবর্তনের প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন ছিলেন জ্ঞানের সাধক। সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষের দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি অনুভব করেন পাশাপাশি যুগ যুগ ধরে বসবাস করলেও তাদের এক সম্প্রদায়ের সদস্যরা অন্য সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি সম্পর্কে খুব কমই জানেন। বিশেষ করে মুসলমান সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ধারণায় রয়েছে অনেক অস্পষ্টতা। এ অস্পষ্টতার অবসান ঘটাতে তিনি ইসলাম নিয়ে গবেষণা করেন এবং দীর্ঘ গবেষণা শেষে লেখেন ‘ইসলাম ধর্মের রূপরেখা’ নামে একটি বই। ইতিহাস, কোরআন ও হাদিসের নিরিখে তিনি তাঁর বইতে মুহাম্মদ (সা.)-এর যে মূল্যায়ন করেছেন তা এককথায় অতুলনীয়।
মহানবী (সা.)-এর সময়কার আরবের অবস্থা সম্পর্কে রাহুল সাংকৃত্যায়ন লিখেছেন, ‘নরবলি, ব্যভিচার, মদ্যপান, জুয়াখেলা ইত্যাদিতে তারা যারপরনাই আসক্ত ছিল। প্রাক-ইসলাম যুগে আরবে পিতার মৃত্যুর পর তার অগুনতি বিধবা স্ত্রীকে সম্পত্তির মতো উত্তরাধিকারসূত্রে পুত্রদের মধ্যে বণ্টন করা হতো এবং পুত্ররাও তাদের নিজেদের স্ত্রীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করত। রাজপুত্র ইমরুল কায়েস রচিত কাব্য, যেখানে কবি তাঁর ফুপাতো বোনের প্রতি দুরভিসন্ধিমূলক ব্যভিচারের কাহিনি বর্ণনা করেছেন, সেরকম নিকৃষ্ট কাব্যগ্রন্থকেও তৎকালীন লোকেরা মহাপ্রসন্নতার সঙ্গে কাবার মতো পবিত্র ও শ্রেষ্ঠ উপাসনালয়ে স্থান দিয়েছিল। সামন্ত প্রভুরা কিংবা পরিবারের প্রতিভূরা মহানন্দে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহ চালিয়ে যেতেন। যে কোনো একজনের নিহত হওয়ার অর্থ ছিল নিহত এবং হত্যাকারীর দুই পরিবারের মধ্যে চিরকালীন শত্রুতার আরম্ভ। জন্মের পর মাতৃদুগ্ধের সঙ্গেই শিশুকে তার শত্রু পরিবার সম্পর্কে ঘৃণার আগুন পান করানো হতো, যাতে তার হৃদয়ে প্রতিশোধের বাসনা সদাজাগ্রত থাকে। যুদ্ধে বন্দি হওয়া স্ত্রী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধদের শির-েদ করা অতিসাধারণ বিষয় ছিল।’ মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর বইতে লিখেছেন- ‘এরকম এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট, মতান্তরে ২৯ আগস্ট কিংবা ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ অথবা ২১ এপ্রিল মক্কার প্রসিদ্ধ হিশাম বংশে মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ছিল আবদুল্লাহ ও মায়ের নাম আমিনা। মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় মুহাম্মদ (সা.)-এর পিতৃবিয়োগ হয়। মা ও পিতামহ আবদুল মুত্তালিবের স্নেহচ্ছায়ায় তিনি লালিতপালিত হতে থাকেন। শিশু বয়সেই তাঁর মা মারা যান। পুত্র এবং পুত্রবধূর বিয়োগব্যথায় কাতর পিতামহ আবদুল মুত্তালিবের হৃদয়ের সব বাৎসল্যরস সিঞ্চিত করে পৌত্রের লালনপালনের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন। কিন্তু এমতাবস্থাতেও ভাগ্যের বোধ হয় সম্মতি ছিল না। বালক মুহাম্মদের আট বছর বয়সে তাঁর পিতামহেরও দেহাবসান হয়। মৃত্যুকালে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব তাঁর আরেক পুত্র আবু তালিবকে ডেকে বালক মুহাম্মদকে পুত্রবৎ লালনপালনের আদেশ দিয়ে যান।’
মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে আরবের ধর্মীয় অবস্থা বর্ণনা করে রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘প্রাচীনকালে আরবের ওই অঞ্চলে মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল না। কাবা শরিফের প্রধান পুরোহিত অমরু শাম দেশ বা ফিলিস্তিনে গিয়ে শোনেন হুবাল, লাত, মানাত, উজ্জা ইত্যাদি নামের দেবদেবীর আরাধনায় বিপদ-আপদে রক্ষা পাওয়া যায়। যুদ্ধের সময় শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ও লাভ করা যায়। তিনি শাম দেশ থেকে কয়েকটি মূর্তি এনে কাবায় প্রতিষ্ঠা করেন। দেখতে দেখতে এদের প্রচার এত প্রসার লাভ করে যে সারা দেশই মূর্তিপূজায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে। শুধু কাবাগৃহেই ৩৬০টি বিভিন্ন মূর্তি ছিল। এই মূর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল হুবাল, যার অধিষ্ঠান ছিল মন্দিরের ছাদে এবং সেটি ছিল কোরেশদের ইস্টদেব। লোকে বিশ্বাস করত মূর্তিপূজার মাধ্যমে ঈশ্বরের সন্নিকটে পৌঁছানো যায়। মহানবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন অক্ষরজ্ঞানশূন্য। কিন্তু ব্যবহারিক বুদ্ধিমত্তা, সততা ইত্যাদি সদ্গুণের জন্য কোরেশ বংশীয় এক বিত্তশালিনী মহিলা খাদিজার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। খাদিজা তাঁকে তাঁর ব্যবসার কাজে নিয়োগ করেন। মুহাম্মদ (সা.) তাঁর ২৫ বছর বয়সে ব্যবসার কাজে শাম দেশে যান এবং ব্যবসায়িক দায়িত্ব সুনিপুণভাবে পালন ও সততার জন্য খাদিজার সন্তুষ্টি অর্জন করেন। তিনি মহানবী (সা.)-কে বিয়ের প্রস্তাব দেন। খাদিজার বয়স ছিল ৪০ এবং আগের দুই স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি বৈধব্য জীবনযাপন করছিলেন। মুহাম্মদ (সা.) খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
খাদিজা এবং তাঁর ভাই ওয়ারাকা বিন নওফেল ছিলেন মূর্তিপূজাবিরোধী এবং ইহুদি ধর্মের অনুগামী। বিয়ের প্রায় ১৫ বছর পর মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সান্নিধ্যলাভের জন্য হেরা পর্বতে একান্ত সাধনা শুরু করেন। এখানেই স্বর্গীয় দূত বা ফেরেশতা জিবরাইলের মাধ্যমে নাজিল হয় অল্লাহর বাণী পবিত্র কোরআনের প্রথম আয়াত ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক। (পড় তোমার প্রভুর নামে)। মুহাম্মদ (সা.) জিবরাইলের চেহারা দেখে ভয়ে কিছুক্ষণের জন্য মূর্ছিত হয়ে পড়েন। পরে তিনি যখন সব ঘটনা তাঁর স্ত্রী খাদিজা এবং তাঁর ভাই ওয়ারাকা বিন নওফেলকে শোনালেন, তখন তাঁরা বললেন, আপনি অবশ্যই আল্লাহর ফেরেশতার সাক্ষাৎ পেয়েছেন এবং তিনি ঐশী বাক্য নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলেন। তখন থেকেই ৪০ বছর বয়সে মুহাম্মদ (সা.)-এর পয়গম্বর বা রসুলের জীবনের শুভারম্ভ হয়।’
রাহুল সাংকৃত্যায়ন লিখেছেন, ‘আল্লাহর অহি পাওয়ার পর মুহাম্মদ (সা.) মক্কার দাম্ভিক মূর্তিপূজারিদের কোরআনের উপদেশ শোনাতে আরম্ভ করেন। মেলার বিশেষ দিনে দূরদূরান্ত থেকে আগত তীর্থযাত্রীদের সমাবেশে তিনি ছলকপটতাযুক্ত লোকাচার এবং বহু দেবতার আরাধনার মতবাদকে খণ্ডন করতেন এবং এক আল্লাহর উপাসনা এবং বিশুদ্ধ সরল ধর্মাচরণের উপদেশ দিতেন। মক্কার কোরেশ বংশীয়রা তাদের ইস্টদেব, আচার-আচরণ এবং উপার্জনের উপায়কে এভাবে নিন্দা করতে দেখেও হাশিম পরিবারের শত্রুতার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণনাশের সাহস করেনি। কিন্তু এই নবীন ধর্মে দীক্ষিত দাসদাসীদের ওপর তারা অত্যাচার আরম্ভ করে। তাদের উত্তপ্ত বালুকারাশির মধ্যে শুয়ে থাকতে বাধ্য করা হতো। চাবুক মারাসহ আরও নানা ধরনের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা দিত। কিন্তু এত অত্যাচার সত্ত্বেও এই নতুন ধর্মের অনুসরণকারীরা তাঁদের ধর্মপথ ত্যাগ করেননি কিংবা প্রলোভন দেখানো সত্ত্বেও তাঁদের ধর্মবিশ্বাস বিন্দুমাত্র শিথিল হয়নি। কুরাইশদের নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে মুহাম্মদ (সা.) তাঁর অনুসারীদের আবিসিনিয়ায় হিজরতের নির্দেশ দেন। সে দেশের ন্যায়পরায়ণ রাজার অনুগ্রহ লাভে সমর্থ হয় মুসলমানরা। ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর সরাসরি হামলা থেকে কুরাইশরা বিরত থাকলেও পিতৃব্য আবু তালিবের মৃত্যুর পর তারা দ্বিধাসংকোচ ত্যাগ করে মহানবী (সা.)-এর বিরোধিতায় উঠেপড়ে লাগে।’
রাহুল সাংকৃত্যায়ন লিখেছেন, ‘কোরেশরা মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু করে। একদিন মহানবী (সা.)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে তারা তাঁর বাসভবন ঘিরে ফেলে। তবে পয়গম্বর কোরেশদের হীন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আগেভাগে জানতে পারেন এবং মদিনায় চলে যান। মদিনার আগের নাম ছিল ‘ইয়াসরিব’। মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় যাওয়ার পর এ নগরীর নাম হয়- মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। মদিনা নগরেও নবী মুহাম্মদ (সা.) বেশি দিন শান্তিতে থাকতে পারেননি। কোরেশরা সেখানেও তাঁকে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। স্বীয় অনুগামীদের রক্ষা করার উপায়ান্তর না দেখে, তাঁকে মদিনাবাসী ইহুদিদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করতে হয়। ইহুদিরা ছিল কোরেশদের হীন চক্রান্তের অন্যতম সহায়ক। এই যুদ্ধের পরিসর বিস্তৃত হতে থাকে এবং যার পরিসমাপ্তি ঘটে মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে। মক্কা বিজয়ের পর পবিত্র কাবা শরিফকে মূর্তিশূন্য করা হয়। জন্মস্থান মক্কা জয়ের পরও মদিনাবাসীর ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে মুহাম্মদ (সা.) তাঁর অমূল্য জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত মদিনাতেই অবস্থান করেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই আরব ভূখণ্ড এক রাষ্ট্রসূত্রে গ্রোথিত হয়ে ইসলাম ধর্ম স্বীকার করে। ৬৩ বছর বয়সে মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবনের মহান উদ্দেশ্য সমাপ্ত করে সমগ্র শিষ্যমণ্ডলীকে অসীম দুঃখসাগরে ভাসিয়ে প্রাণত্যাগ করেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের ৪০তম বছরে ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’ থেকে আরম্ভ করে মৃত্যুর ১৭ দিন আগপর্যন্ত (ভিন্নমতে ১২ দিন) ‘রাব্বিকাল আকরাম’ (প্রভু তুমি অত্যন্ত মহান) বাক্যের অবতীর্ণ হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর যে বাণী তিনি প্রচার করেছেন তার সমগ্র সংগ্রহের নামই ‘কোরআন শরিফ’ বা পবিত্র কোরআন। এই পবিত্র কোরআন ইসলাম ধর্মের চলার পথের গাইডলাইন।
লেখক : সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
ইমেইল : [email protected]