আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হবে বলে আবারও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পরামর্শ চেয়েছেন তিনি। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ফেব্রুয়ারিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সাতটি রাজনৈতিক দল ও একটি সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে এবি পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় গণফ্রন্ট ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে দলগুলো তাদের মতামত ও বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে। জীবনে যারা ভোট দিতে পারেনি তাদেরকে এই নির্বাচনে ভালো অভিজ্ঞতা দিতে হবে। যারা অতীতে ভোট দিতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন, তাদেরকেও ভালো অভিজ্ঞতা দিতে হবে। কেউ যেন বলতে না পারে যে আমাকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। যারা অন্তর্বর্তী সরকারকে পৌঁছাতে দিতে চায় না, তারা যত রকমভাবে পারে বাধা দেবে। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন নির্বাচন বানচাল করার। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে যাতে নির্বাচন না হয়। সেই লক্ষণ এখন দেখা যাচ্ছে, সামনে আরও আসবে, এজন্য আমাদেরকে আরও সতর্ক হতে হবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে নির্বাচন করার এবং নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচিত সরকারের হাতে আমরা ক্ষমতা হস্তান্তর করব। রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন নয়। এটা দেশের সব মানুষের, সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচন। এটা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের নির্বাচন, নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর সাহস অর্জন ও নিজের ভঙ্গিতে দেশ পরিচালনার নির্বাচন। এই নির্বাচনে অন্য কোনো দেশের থাবা মারার সুযোগ যেন না থাকে, এ ব্যাপারে আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই।
শফিকুল আলম জানান, প্রধান উপদেষ্টা বারবার বলেছেন, প্রতি পদে পদে বাধা আসবে। সবার মনে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে, আমরা সবাই যেন এক থাকি, একে অন্যকে সহযোগিতা করি। প্রেস সচিব বলেন, সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে দুর্গাপূজা। এ পূজাকে ঘিরে কোনো গোষ্ঠী যেন কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র এবং অস্থিতিশীলতা করতে না পারে সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সজাগ থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, পূজায় অনেকে গন্ডগোল করার চেষ্টা করবে, অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করবে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

এদিকে বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিং করে রাজনৈতিক দলগুলো। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ বলেন, বৈঠকে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিষয়ে আলোচনা হয়নি। আমরা বলেছি, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। যেসব অস্ত্র লুণ্ঠন হয়েছে সেগুলো উদ্ধার করা হয়নি। এটা নির্বাচনে ঝুঁকি বাড়াবে। এ ছাড়া পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অযৌক্তিক এবং আইনগতভাবে অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের মানুষ পিআর পদ্ধতি বোঝে না। নেপালে এই পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের ফলে ১০ বছরে ছয়বার সরকার বদল হয়েছে। এই পদ্ধতি আমেরিকা, ইতালিসহ উন্নত দেশে নেই।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, নুরুল হক নুরের ওপর হামলা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তুচ্ছ ঘটনায় সংঘটিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। নির্বাচনে অতীতে যারা সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন, প্রয়োজনে তাদের চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া যায় কি না তা বিবেচনা করা যেতে পারে। নির্বাচনি সহিংসতা রোধে জাতীয় পর্যায় থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নিয়ে নির্বাচন সমন্বয় কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক ড. আশরাফ আলী আকন বলেন, মৌলিক সংস্কার ও দৃশ্যমান বিচার কার্যক্রম ছাড়া জাতীয় নির্বাচন হবে না বলে জানিয়েছেন তারা। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন হতে হবে পিআর পদ্ধতিতে। ৩১টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৬টি পিআর পদ্ধতি চায়। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। নির্বাচন পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য সেপ্টেম্বরের মধ্যেই একটি স্বতন্ত্র কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী আরও বলেন, যেসব সংস্কার প্রস্তাবে সবাই একমত এবং যেগুলো সংবিধান সংশ্লিষ্ট নয়- সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুর রহমান ইসলামাবাদী বলেন, ‘আমরা দাবি জানিয়েছি, সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল করতে। জুলাই সনদে শাপলা চত্বরে যে গণহত্যা হয়েছে তা অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছি। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের চিহ্নিত ক্রিমিনাল, দোসর তাদের গ্রেপ্তার করতে বলেছি।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, যারা এখন প্রশাসন ও বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান তারা কি আপনার সরকারে আনুগত্য প্রকাশ করছে? সহযোগিতা করছে? আমরা দেখছি করছে না। তাই আমরা বলেছি, এখানে দুটি সরকার কাজ করছে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, আরেকটা অদৃশ্য সরকার। গণভোটের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণভোটের সুযোগ নেই। এখন যেহেতু রাজনৈতিক মহলে গণভোটের দাবি উঠেছে সে ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কী হবে তা স্পষ্ট করতে বলেছি। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে সরকারের পক্ষ থেকে এটা স্পষ্ট করার কথা বলেছি। নাগরিক ঐক্য ও গণফ্রন্ট বৈঠকে থাকলেও সংবাদ সম্মেলনে আসেনি।