সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর এখন সবার মনোযোগের কেন্দ্রে। এলাকার পাথর লুটপাটের ঘটনা নিয়ে এই আলোচনা। সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরের এই স্থান অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের ভিতরে ও বাইরে থেকে আগত ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এখানকার অপর আকর্ষণ হচ্ছে এর পাথর কোয়ারি বা খোলা খনি। প্রাকৃতিকভাবেই এখানে পাথর মজুত হয়ে গড়ে উঠেছে এই কোয়ারি। স্বচ্ছ পানির এ আধার এলাকার বেশ কিছু স্থানের খাওয়ার পানির চাহিদা মেটায়। প্রধানত চুনাপাথর ও জীবাশ্মযুক্ত ঝিনুক দিয়ে গঠিত এই পাথরগুলো লাখ লাখ বছর ধরে নদীর প্রবাহে ক্ষয়প্রাপ্ত ও মসৃণ হয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় অপূর্ব সুন্দর এক পাথরের সমাহার। সবুজ পাহাড় ও ঘন বনভূমির মাঝে সাদাপাথরের সজ্জা সত্যি মনোমুগ্ধকর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি, সাদাপাথরের রয়েছে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। শত শত বছর ধরে এখানকার পাথর মন্দির, প্রাসাদ ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্থানীয় কারিগররা এই পাথর দিয়ে সূক্ষ্ম নকশা ও ভাস্কর্য তৈরি করেন, যা পর্যটকরা শৌখিন সাজসজ্জা ও নির্মাণকাজে ব্যবহার করেন। মেঘালয়ের পাহাড়ি ঝরনার পানির স্রোতে বেয়ে আসে সাদাপাথর। নদের উৎসমুখে পাথরের বিশাল স্তূপের কারণে ভোলাগঞ্জের প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে তৈরি সাদাপাথর নামক স্থানটি পর্যটন স্পট হিসেবে গত কয়েক বছরে বেশ সাড়া ফেলেছিল।
২০১২ সাল থেকে মূলত এই স্থানটি পর্যটন স্পটে পরিণত হলেও ২০১৭ সালে একে সাদাপাথরের পর্যটন স্পট ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকে দেশ ও দেশের বাইরে এই নাম ছড়িয়ে গেছে বিদ্যুৎ গতিতে। সম্প্রতি পাথর লুটের কারণে স্থানটি যেন কঙ্কালসদৃশ বিরানভূমিতে পরিণত হয়। এলাকাবাসীর মতে, ৫ আগস্টের পর থেকে সাদাপাথর লুট হওয়া শুরু হয়। প্রশাসনের নীরবতা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রশাসনও ছিল অনেকটা নীরব। ঠিক এক বছর আগেও এই স্থানের সৌন্দর্যকে ‘অনবদ্য ক্যানভাস’-এর সঙ্গে তুলনা করা যেত। যত দূর চোখ যেত কেবল সাদাপাথর আর স্বচ্ছ নীল পানি, পাহাড় ও মেঘের আলিঙ্গন নজরে পড়ত। সবুজ উপত্যকা, স্বচ্ছ নির্মল হ্রদ এবং মনোমুগ্ধকর ফুলের বাগান ও পাহাড়ের ঢালে পর্যটকদের মাখামাখি এক সুতোয় গাঁথা ছিল। সূর্যের আলোতে সাদাপাথরগুলো জ্বলজ্বলে সোনালি আভা ছড়াত, যা পর্যটকদের মনে এক অদ্ভুত মায়া সৃষ্টি করত। বর্ষায় সাদাপাথরগুলোর সৌন্দর্য আরও বহু গুণে বৃদ্ধি পেত, অতিবৃষ্টির ফলে নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাথরগুলো আরও উজ্জ্বল ও ঝকঝকে হতো। প্রাকৃতিকভাবেও এই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। পাথরগুলো যেখান থেকে ন্যাচারালি আসে, ওইখান থেকে পানি প্রবাহের ভয়ংকর রকম তোড় তৈরি হয়। পাথর ওই তোড়ের পানিটাকে ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো করে গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। শুধু তা-ই নয় পানির মধ্যে অক্সিজেন সংশ্লেষ করাও এর কাজ, যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘সোলার অ্যাকুয়াটিক ন্যাচারাল প্রসেস অব ট্রিটমেন্ট’ বলা হয়; কিন্তু পাথর লুটপাট হলে প্রকৃতির এই সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটবে এবং দুপাশে প্লাবনের পরিমাণ বাড়বে, ভাঙনের সৃষ্টি হবে এবং পানিটাকে গোড়াতেই সাংঘাতিকভাবে পলিউটেড (দূষিত) করবে। প্রকৃতির এই স্বাভাবিক কার্যপ্রণালি যেন হারিয়ে গেল কিছু আসাদু ও লোভী লোকের কালোথাবার কারণে।
ভোলাগঞ্জের শুধু সাদাপাথর নয়, দেশের প্রধান অন্যান্য কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্রও রয়েছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এগুলো হলো- ১. রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট : বিশ্বে মাত্র ২২টি মিঠাপানির জলাবন রয়েছে, যাদের মধ্যে রাতারগুল অন্যতম। কিন্তু সেখানে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য নিষ্কাশন এবং পর্যাপ্ত রেসকিউ টিমের অভাবে ডুবতে বসেছে এই মিঠাপানির পর্যটন স্থানটি। ২. মহাস্থানগড়- বাংলার প্রাচীনতম নগরী বগুড়ার মহাস্থানগড়। রাষ্ট্রের অবহেলা আর দখলদারিতে অস্তিত্ব হারাচ্ছে ঐতিহাসিক এই পর্যটন কেন্দ্রটি। ৩. সুন্দরবন- পরিবেশ সংরক্ষণের নামে বছরের অর্ধেক সময়েই পর্যটকদের জন্য বন্ধ রাখা হয়, যা পর্যটন খাতের উন্নয়নকে আরও বাধাগ্রস্ত করছে। অবৈধভাবে গাছ কাটা ও চোরা শিকারিতে দিনদিন কমে যাচ্ছে পৃথিবী খ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং মায়াবী হরিণ। ফলে অস্তিত্ব হারাচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বনটি। ৪. সাজেক ভ্যালি- মেঘ ও প্রকৃতির এক অদ্ভুত মিলনমেলা রাঙামাটির সাজেক ভ্যালি। কিন্তু সেখানকার স্থানীয় গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারের লড়াই হুমকিতে ফেলেছে এখানকার পর্যটনশিল্পকে। এ ছাড়া নিরাপত্তাহীনতা পর্যটকদের ওপর ফেলছে মারাত্মক প্রভাব। ৫. সেন্ট মার্টিন- জীববৈচিত্র্য রক্ষার নামে পর্যটন সীমিত করা হয়েছে। ফলে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটিতে স্থানীয় অর্থনীতি ও পর্যটননির্ভর ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়