এই অক্টোবরে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০তম বার্ষিকী উদ্যাপিত হচ্ছে। ২০২৫ সাল চীনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বছর, যা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। বিগত পাঁচ বছরে কমরেড শি জিনপিং-এর দিকনির্দেশনায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সফল নেতৃত্বে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের কাজের ওপর মনোনিবেশ করেছে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়ে ও কঠিন পরীক্ষা মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে চীন গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। চতুর্দশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) চলাকালে চীনের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) গড়ে বার্ষিক ৫.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ধারাবাহিকভাবে প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রেখেছে চীন। বৈশ্বিক উন্নয়নে চীন আজ সবচেয়ে স্থিতিশীল, নির্ভরযোগ্য ও ইতিবাচক পরিবর্তনের অনন্য উদাহরণ।
এ বছর একই সঙ্গে চীনা জনগণের জাপানি আগ্রাসনবিরোধী প্রতিরোধযুদ্ধ ও বিশ্ব ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধের বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী। চীনের মহামান্য প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাঁর ভাষণে দৃঢ় কণ্ঠে পুনর্ব্যক্ত করেছেন, ‘চীনের জনগণ সবসময় ইতিহাসের সঠিক পথে এবং মানব সভ্যতার অগ্রগতির পক্ষে অবস্থান করেছে। আমরা শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের পথে অবিচল থাকব এবং সারা বিশ্বের মানুষের সঙ্গে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে মানবজাতির অভিন্ন কল্যাণের সমাজ গড়ে তুলব।’ ৮০ বছর আগে বিপুল জাতীয় ত্যাগ স্বীকার করে চীনের জনগণ মানব সভ্যতাকে রক্ষা ও বিশ্ব শান্তি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রধান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীনের অর্জন সবচেয়ে উজ্জ্বল। চীন চরম দারিদ্র্যদূরীকরণে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে এবং বিশ্বশান্তি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্য একটি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে এসেছে। ২০২৫ সাল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৮০তম বার্ষিকী। বর্তমানে বিশ্ব শতাব্দীর মধ্যে দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আঞ্চলিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা, আইন ও নীতিমালার ঘাটতি এবং ক্রমবর্ধমান শাসন ব্যবস্থাপনার ঘাটতি বিদ্যমান। মানবজাতি আবারও শান্তি না যুদ্ধ, সংলাপ না সংঘাত, উইন-উইন কো-অপারেশন না জিরো-সাম গেম, এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি। শান্তি ও উন্নয়ন সমুন্নত রাখা, জাতিসংঘ সনদ সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা কেবল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরি প্রত্যাশাই নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত দায়িত্বও বটে।
সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের তিয়ানজিন সম্মেলনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং গ্লোবাল গভর্ন্যান্স ইনিশিয়েটিভ (জিজিআই) প্রস্তাব করেন। জিজিআই-এর পাঁচটি মূল ধারণা হচ্ছে- সার্বভৌম সমতা বজায় রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক আইনের শাসন মেনে চলতে হবে, বহুপাক্ষিকতা অনুশীলন করতে হবে, জনকেন্দ্রিকতার পক্ষে কথা বলতে হবে এবং কর্মমুখীকরণের ওপর মনোনিবেশ করতে হবে। জিজিআই (এএও), গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ এবং গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং উদ্যোগটি অশান্ত বিশ্বে স্থিতিশীলতা ও নিশ্চয়তা বজায়ে এবং বৈশ্বিক সুশাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে চীনের প্রজ্ঞা ও সমাধানকে আরও বেশি অর্থবহ করে তুলতে ভূমিকা রাখে। চীন সম্প্রতি বিশ্বকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, একটি দায়িত্বশীল প্রধান উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিওটিও)-এর আলোচনায় চীন আর বিশেষ ও ভিন্নধর্মী সুবিধা চাইবে না। চীনের এই অবস্থান বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার এবং সংশ্লিষ্ট বৈশ্বিক উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি এ পদক্ষেপ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন গতি সঞ্চার করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ২০২৫ সালের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এ বছর এই দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী এবং একই সঙ্গে চীন-বাংলাদেশ জনগণের বিনিময় বর্ষ। পঞ্চাশ বছরের যাত্রাপথে ফিরে তাকালে দেখা যায়, চীন ও বাংলাদেশ সবসময়ই ভালো প্রতিবেশী, আন্তরিক বন্ধু ও নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে একে অন্যের পাশে থেকেছে। গত মার্চ মাসে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরের গন্তব্য হিসেবে চীনকে বেছে নেন। বেইজিংয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং-এর সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের সাক্ষাৎ হয়। দুই নেতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য কৌশলগত দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করেন। বেশ কয়েকটি প্রধান রাজনৈতিক দলের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলও দারুণ সফলতার সঙ্গে চীন সফর করেছে। চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়।
উভয় দেশই ‘দুই পক্ষের জন্য লাভজনক’- এ নীতিতে অবিচল থেকেছে এবং একসঙ্গে উচ্চমানসম্পন্ন বেল্ট অ্যান্ড রোড কো-অপারেশন এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করেছে। টানা ১৫ বছর ধরে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। গত আগস্ট থেকে ২০টিরও বেশি চীনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি অংশীদারদের সঙ্গে ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও (সম্ভাব্য) বেশি বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎসে পরিণত হয়েছে চীন। উভয় দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার নীতিতেও অবিচল রয়েছে। আমরা একসঙ্গে জুলাই আন্দোলনে আহতদের জন্য চিকিৎসাসেবা দিয়েছি এবং মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় আহত শিশুদের জন্য জরুরি সহায়তা পৌঁছে দিয়েছি। রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, গণমাধ্যম ও তারুণ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিময় ও সহযোগিতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ দুই দেশের মধ্যে জনসম্পৃক্ততা ও সফরের সংখ্যা এ বছর ২ লাখ ছাড়িয়েছে, যা আমাদের জনগণের বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক বোঝাপড়া আরও গভীর করেছে। সুখে-দুঃখে একে অন্যের পাশে থাকার নীতিই সর্বদা চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের মূল বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনব্যবস্থা সমর্থন করে চীন এবং সুষ্ঠু ও সফলভাবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পাশাপাশি এর জাতীয় অবস্থার জন্য উপযোগী উন্নয়ন পথ অনুসরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে। চীন ও বাংলাদেশ এখন নতুন এক ঐতিহাসিক সূচনাবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের আধুনিকায়নের প্রয়াসে চীন বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে প্রস্তুত এবং অভিন্ন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চীন-বাংলাদেশ নতুন অধ্যায় রচনায় বদ্ধপরিকর।
চীন-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব আরও সুদৃঢ় হোক। দুই দেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমৃদ্ধ হোক। দুই দেশের জনগণের জীবনে শান্তি ও কল্যাণ বজায় থাকুক।
বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে মাও সেতুং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেছিলেন
চীনের গর্ব আর উৎসবের দিন
১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর। দিনটিতে চীনের ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়। ঐতিহাসিক এ দিনে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে মাও সেতুং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেছিলেন। দীর্ঘ সংগ্রাম, বিপ্লব ও আত্মত্যাগের পর জন্ম নেয় একটি রাষ্ট্র।
চীনের জনগণের কাছে দিনটি ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে পালন হয় পূর্ণ মর্যাদায়।
এ উপলক্ষে পুরো চীন সাজে উৎসবের বর্ণিল রঙে। রাজধানী বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয় সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন। সেখানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সামরিক কুচকাওয়াজ, আতশবাজির ঝলকানি এবং সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী পুরো বিশ্বে সাড়া ফেলে। বিশেষ করে সামরিক প্রদর্শনীতে চীনের আধুনিক প্রযুক্তি ও সামরিক সক্ষমতার পরিচয় তুলে ধরা হয়, যা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ ছাড়া দেশজুড়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী এবং জনসম্পৃক্ত কার্যক্রম। এ দিনটি চীনের অগ্রগতির প্রতীক। গত কয়েক দশকে দেশটি প্রযুক্তি, শিল্প, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে যে উন্নতি করেছে, তা এ দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে প্রতিফলিত হয়। জাতীয় দিবসকে কেন্দ্র করে চীনে ঘোষণা করা হয় টানা সাত দিনের ছুটি। যা ‘গোল্ডেন উইক’ নামে পরিচিত। এ সময়ে কোটি কোটি মানুষ ভ্রমণে বের হন। পর্যটন কেন্দ্র, ঐতিহাসিক স্থান, বিনোদন পার্ক এবং শপিং মলগুলো হয়ে ওঠে জনসমুদ্র। চীনের জাতীয় দিবস রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; সাধারণ মানুষও এ দিনকে নিজেদের মতো করে পালন করে। কেউ পরিবার নিয়ে ভ্রমণে যায়, কেউ অংশ নেয় স্থানীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে।