বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা কি দূর হয়ে গেছে? নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে ধোঁয়াশা কি কেটে গেল? অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠক কি রাজনীতির বরফ গলিয়ে সুবাতাস বয়ে আনতে পারল? রাজনীতির মাঠে-ময়দানে এমনিতর নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কী হলো লন্ডন বৈঠকে? লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে দীর্ঘ সময় ধরে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতার মধ্যে বহুল আলোচিত বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে সর্বমহলে কৌতূহলের কোনো কমতি ছিল না।
বৈঠকে কিছু সময় দুই পক্ষের প্রতিনিধিদল অংশ নিলেও এক ঘণ্টারও বেশি সময় দুই নেতা একান্তে মিলিত হয়েছেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন সরকার এবং বিএনপির প্রতিনিধিরা। একটি সংক্ষিপ্ত যৌথ বিবৃতিও পড়ে শোনানো হয়েছে।
কী আছে যৌথ বিবৃতিতে? সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিবৃতি নিয়ে দুই পক্ষই তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। দেশে এখন অনেকেই লন্ডন বৈঠকের বিবৃতির পোস্টমর্টেম করেছেন। বৈঠকের ওপর গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে রোজার এক সপ্তাহ আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে লন্ডনে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোনো কোনো সংবাদপত্র আগ বাড়িয়ে দিন-তারিখও দিয়ে দিয়েছে।
এখন দেখা যাক, যৌথ বিবৃতিতে কী বলা হয়েছে? যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যদি প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সংস্কার ও বিচারকার্যে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়, তাহলে নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হতে পারে। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা পবিত্র ঈদুল আজহার আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এ কথা পরিষ্কার করেই সিদ্ধান্তের মতো ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারিতে রোজার এক সপ্তাহ আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে উল্লিখিত সময় আর লন্ডনের বিবৃতির সময় একভাবে বলা হয়নি, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এদিকে দুই নেতার শীর্ষ বৈঠক বিশেষ করে যৌথ বিবৃতি নিয়ে জামায়াত, এনসিপিসহ আরও দুই-একটি দল নাখোশ হয়েছে। তারা বলছে, কেন বিদেশে বসে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হলো। সময়সীমা কি আসলেই নির্ধারিত হয়ে গেছে? সময়সীমা নিয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা কি দেওয়া হয়েছে? তা হয়নি। জামায়াতের বিরাগভাজন হওয়ার কারণ বোধগম্য নয়। জামায়াতের আমির ডা. শফিকও কিছুদিন আগে প্রেসের সামনে রোজার আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযুক্ত সময় বলেছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, বৈঠক শেষে জাতিকে আশ্বস্ত করার জন্য একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করেছেন, এখানে দোষটা কী। তবে কি জামায়াত চেয়েছিল সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্কের সৃষ্ট দূরত্ব নিরসন না হয়ে বরং তা জিইয়ে থাকলে এর মধ্য থেকে তারা নিজেদের ফায়দা হাসিল করবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ঈদুল আজহা উপলক্ষে ভাষণে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার আগে কি সব দলের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? জামায়াত, এনসিপিসহ দুই-তিনটি পার্টি তখন ত্বরিত ঘোষিত সময়সূচিকে স্বাগত জানিয়েছিল। বিএনপিসহ অধিকাংশ দল এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে। কই তখন তো কেউ বলেনি জামায়াত-এনসিপির প্রতি সরকারের বিশেষ অনুরাগ রয়েছে। জামায়াত নির্বাচন নিয়ে কোনো জাতীয় বিবেচনা নয়, বরং সংকীর্ণ দলীয় বিবেচনা থেকে আগাগোড়াই একেক সময় একেক কথা বলেছে। যা নীতিনৈতিকতার বিচারে সমর্থনযোগ্য নয়। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সবাইকে দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়াটাই জরুরি। নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপিও হতাশা ব্যক্ত করে বলেছে, লন্ডন বৈঠকে বিচার ও সংস্কার যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। অথচ যৌথ বিবৃতিতে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, বিচার এবং সংস্কারে যথেষ্ট অগ্রগতি সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই কেবল ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে। তাহলে এনসিপির মন খারাপ করার কোনো কারণ তো দেখছি না। এনসিপি সরকারের ভিতরে বাইরে থেকে সব সুযোগসুবিধা নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রলম্বিত করার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে দল গুছিয়ে তোলার জন্য, এ কথা কে না বোঝে!
লন্ডন বৈঠকের ফলাফলে বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো দারুণভাবে উচ্ছ্বসিত। উচ্ছ্বসিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি। লন্ডন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে সরকারের উদ্যোগে। কেউ কেউ মনে করছেন, ড. ইউনূসের এবারের লন্ডন সফরের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের টানাপোড়েনের অবসান ঘটানো এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান নানা ইস্যুতে একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছানো। যাতে করে রাজনীতিতে স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি হয়। বৈঠকের শুরু এবং শেষটা যদি আমরা খেয়াল করি, তাহলে দেখব, একটা অসাধারণ প্রাণোচ্ছল পরিবেশে বৈঠকটি শুরু ও শেষ হয়েছে। বিএনপি নেতা তারেক রহমান বৈঠকের শুরুতে এবং বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে হোটেলের সামনে সমবেত নেতা-কর্মীদের হাস্যোজ্জ্বল মুখে হাত নেড়ে অভিবাদন গ্রহণ করেছেন। উপরন্তু দীর্ঘ সময় ধরে দুই নেতার বৈঠক। ধরেই নেওয়া যায়, দেশের বর্তমান ভবিষ্যতের নানা রাজনৈতিক ইস্যু, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে দুই নেতার মধ্যে নিবিড় আলোচনা হয়েছে, হয়তো কোথাও কোথাও ঐকমত্যও তৈরি হয়েছে। ফলে বিএনপি এবং সমমনাদের সমর্থকরা বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হবেন, এটা ধরেই নেওয়া যায়।
লন্ডন বৈঠকের রেশ কাটতে না কাটতেই কতগুলো প্রশ্ন ঘুরেফিরে সামনে আসছে। লন্ডনে সাংবাদিকদের সামনে সরকারের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে। বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এরই মধ্যে এ দাবি তুলেছেন। নির্বাচন কমিশন বলছে তারা এখন পর্যন্ত কোনো সিগন্যাল পায়নি।
এখন লন্ডন বৈঠকের যুক্ত বিবৃতিতে উল্লিখিত পর্যাপ্ত সংস্কার ও বিচারের অগ্রগতি এবং সব প্রস্তুতি সম্পন্ন বলতে সরকার পক্ষ কী বোঝাতে চাইছে, তা কিন্তু খোলাসা করেনি। তবে কী আবারও কম সংস্কার অথবা বেশি সংস্কারের মারপ্যাঁচের মধ্যে আমরা পড়ে গেলাম। আমরা তা মনে করতে চাই না। বিশ্বাস করতে চাই, দুই নেতা দীর্ঘ সময় ধরে একান্তে আলোচনায় এসব নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছেন।
লন্ডন বৈঠক নিয়ে দুই-একটি দল মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখালেও এ কথা ঠিক এই হাইভোল্টেজ বৈঠক বাংলাদেশের রাজনীতিতে আপাতত অস্থিরতা কাটিয়ে স্বস্তির বাতাবরণ তৈরি করেছে। দেশ-বিদেশের কোনো চক্রান্ত যেন এই স্বস্তির পরিবেশকে নষ্ট করতে না পারে, তা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে দায়িত্বশীল থেকে পাহারা দিয়ে দেশকে নির্বাচনের ট্রেনে তুলে দিতে হবে। যাতে করে রোজার আগেই কাক্সিক্ষত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেওয়া যায়।
লেখক : নব্বইয়ের ছাত্র-গণ আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষনেতা