মুম্বাইয়ের অন্যতম হিট সিনেমা ‘নায়ক’। ২০০১ সালে মুক্তি পাওয়া এ সিনেমাটি অনেকেই দেখে থাকবেন। ছবিটির কাহিনিবিন্যাস, সিকোয়েন্স এবং শক্তিমান অভিনেতা অমরেশপুরি, নায়ক অনিল কাপুর ও পরেশ রাওয়ালের অভিনয়গুণে তা বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। একটি ছোট্ট ঘটনায় বাস ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে লুটপাট, ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনা বন্ধে মুখ্যমন্ত্রী বলরাজ চৌহান (অমরেশপুরি) কোনো দিকনির্দেশনা দেন না। টিভি ক্যামেরাম্যান শিবাজি রাও (অনিল কাপুর) পুরো ঘটনা রেকর্ড করে। পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর কথোপকথনও ক্যামেরাবন্দি করে সে। দুঃসাহসিক রিপোর্টে সাড়া পড়ে যায়। শিবাজি রাওকে কর্তৃপক্ষ রিপোর্টার হিসেবে পদোন্নতি দেয়। তার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর লাইভ সাক্ষাৎকার নেওয়া। রিপোর্টার শিবাজি রাওয়ের প্রশ্নবাণে জর্জরিত মুখ্যমন্ত্রী বিব্রত ও ক্ষুব্ধ হন। কেননা, শিবাজি তার দুর্নীতিসহ সব ব্যর্থতার কথাই তুলে ধরে; যেগুলোর জুতসই কোনো জবাব দিতে পারেন না তিনি। ওই সাক্ষাৎকারেই মুখ্যমন্ত্রী রিপোর্টার শিবাজিকে এক দিনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ওই চেয়ার সামলানো কত কঠিন তা দেখতে বলেন। প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হয় শিবাজি রাও। লাইভে তা প্রচারিত হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী পড়েন বিপাকে। অবশেষে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শিবাজি রাও মহারাষ্ট্রের এক দিনের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পায়। সেই এক দিনেই বিপুল সাফল্য দেখায় শিবাজি রাও। দুর্নীতি বন্ধে নেয় কঠোর পদক্ষেপ, ফলে বেড়ে যায় রাজস্ব আদায়।
এক দিন পার হওয়ার পর ভোরে যখন শিবাজি বাড়ি আসছিল, তখন বলরাজ চৌহানের ভাড়াটে গুন্ডারা তাকে আক্রমণ করে। ওদের সঙ্গে মারপিট করে কর্দমাক্ত শিবাজি যখন ফিরে আসছিল, তখন এক বাজারে গিয়ে হাতমুখ ধোয়ার জন্য পানি চায়। পানি দিয়ে মুখ ধুতেই সবাই দেখে এ তো তাদের এক দিনের মুখ্যমন্ত্রী! বালতি ভরে পানি এনে তাকে গোসল করানোর উদ্যোগ নেয় সবাই। এরই মধ্যে একজন বলে, ‘তিনি যেভাবে এক দিনে আমাদের দেশের জঞ্জাল সাফ করেছেন তাকে সেভাবেই পরিষ্কার করতে হবে।’ এই বলে সে এক বালতি দুধ এনে ঢেলে দেয় শিবাজি রাওয়ের শরীরে। এরপর দুর্নীতির অভিযোগে বলরাজ চৌহানের সরকারের পতন হয়। নতুন নির্বাচনে শিবাজি রাও মুখ্যমন্ত্রী হয়। এটা একটা সিনেমার কাহিনি। রুপালি পর্দায় যেটা সম্ভব দেখিয়েছেন পরিচালক এস শংকর, বাস্তবে তা যে সম্ভব নয় সেটা না বললেও চলে। তবে ছবির মূল বক্তব্য হলো একটি সরকার বা সরকারপ্রধান যদি সিদ্ধান্ত নেন, দেশ ও জনগণের জন্য হিতকর কিছু করবেন, তাহলে সেটা করা সম্ভব। তা করতে গেলে অনেক বাধাবিপত্তি হয়তো আসবে, শত্রুতা বৃদ্ধি পাবে। তবে সেসব তোয়াক্কা না করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে সাফল্য কম হোক বা বেশি, ধরা দেবেই। আমার আজকের নিবন্ধের উপজীব্য সেসব রাজনৈতিক গুরুগম্ভীর বিষয় নয়। বরং কথা বলতে চাচ্ছি ‘দুধ-গোসল’ নিয়ে। বাজারের লোকগুলো কর্দমাক্ত অনিল কাপুরকে দুধ দিয়ে গোসল করিয়ে পরিষ্কার করতে চেয়েছে। বাস্তবে দুধ দিয়ে গোসল করলে শরীর বা কোনো কিছুই পুরোপুরি পরিষ্কার হয় না। কেননা, দুধের আঠালো ননীর যে স্তর শরীরে লেগে যায়, তা পরিষ্কার করতে সাবান-পানির দরকার হয়। তারপরও আমরা কোনো অশুদ্ধ কাজকে শুদ্ধ করার প্রসঙ্গে দুধ দিয়ে ধুয়ে ফেলার উদাহরণ দিয়ে থাকে। প্রচলিত ধারণা হলো, কোনো কিছু দুধ দিয়ে ধৌত করা হলে তা শুদ্ধতা বা পবিত্রতা অর্জন করে। যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের মন্দিরের দেবতামূর্তি কিংবা শিবলিঙ্গকে দুধ দিয়ে পূতপবিত্র করে থাকে। বোধ করি সে ধর্মচর্চা থেকেই দুধ দিয়ে অপবিত্রতা দূর করার ধারণাটি মানবমনে প্রোথিত হয়ে থাকবে।
দুধ দিয়ে গোসলের অনেক ঘটনাই আমাদের দেশে মাঝেমধ্যে ঘটে থাকে। খুলনার একসময়ের সন্ত্রাসের মুকুটহীন সম্রাট এরশাদ শিকদারের কথা কারও নিশ্চয়ই ভুলে যাওয়ার কথা নয়। যিনি চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, লাম্পট্য ও সন্ত্রাসের জন্য কিংবদন্তি হয়ে আছেন। সামান্য শ্রমিক থেকে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রশ্রয়ে এরশাদ শিকদার হয়ে উঠেছিলেন সন্ত্রাসের মহিরুহ। তার বাহিনীর নামই পড়ে গিয়েছিল ‘এরশাদ বাহিনী’। শিল্পনগরী খুলনায় তার বিরুদ্ধে কথা বলার লোক ছিল না। কত মানুষকে হত্যা করে তাদের লাশ ভৈরব নদে সে ডুবিয়ে দিয়েছে তার হিসাব আজও পাওয়া যায়নি। ১৯৯৯ সালের ১১ আগস্ট তিনি গ্রেপ্তার হন। এরশাদ শিকদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর পত্রিকায় পড়েছিলাম, প্রতিপক্ষের একজনকে হত্যার পর দুধ দিয়ে গোসল করেছিলেন তিনি। এরশাদ শিকদারের মনের কথা কারও জানার কথা নয়। তবে অনুমান করা যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিটিকে হত্যা করাকে তিনি ‘পবিত্র কাজ’ মনে করেছিলেন। তাই কাজটি সম্পন্ন করে নিজেকে ‘পবিত্র’ করতে ‘দুধ-গোসল’-এর আয়োজন করেছিলেন। মানুষের রক্ত দিয়ে গোসল করা যার নেশা, সেই সিরিয়াল কিলার এরশাদ যখন দুধের মতো পবিত্র জলীয় পদার্থ সহযোগে গোসল করে আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করেন, তখন সেটাকে বিকৃত আনন্দ না বলে উপায় থাকে না।
যাই হোক, দুধ দিয়ে গোসলের ঘটনা মাঝেমধ্যে আমরা সংবাদপত্র মারফত জানতে পারি। কয়েক বছর আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম, আওয়ামী লীগের দুর্নীতি-সন্ত্রাসে ক্ষুব্ধ হয়ে দলটির একজন তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী দুধ দিয়ে গোসল করে দলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আবার ‘দুধে ধোয়া তুলসী পাতা’ বলে একটি প্রবচন প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে। তুলসীপাতা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা-অর্চনায় কাজে লাগে। তাই এটাকে পূতপবিত্র করে সে কাজে লাগানো হয়। কিন্তু তুলসী গাছ দেখলেই কুকুর পা উঁচিয়ে প্রাকৃতিক একটি কর্মসম্পাদন করে। তাই পূজার কাজে লাগানোর আগে দুধ দিয়ে সে পাতাকে ধুয়ে তাকে পবিত্র করে নিতে হয়। এজন্য হিন্দুদের বাড়িতে তুলসী গাছকে একটি উঁচু বেদিতে রাখা হয়; যাতে কুকুর তার নাগাল না পায়। তবে এখন শুধু হিন্দুদের বাড়িতে নয়, অনেক মুসলমানের বাড়িতেও তুলসী গাছ দেখা যায়। এর কারণ তুলসীপাতার ঔষধি গুণ। তুলসীপাতার রস সর্দি-কাশির জন্য অত্যন্ত উপকারী।
যাই হোক তুলসীপাতা নিয়ে তত্ত্বকথার কচকচানি বন্ধ করে দুধের প্রসঙ্গে যাই। সম্প্রতি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে দুধ দিয়ে অফিস পবিত্র করার চেষ্টা করেছেন বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। ৮ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিনের খবরে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তির মিছিলে অংশ নিতে বিএনপির একটি অংশ পতিত আওয়ামী লীগের কিছু কর্মীকে নব্য বিএনপি বানিয়ে দলীয় কার্যালয়ে আসার সুযোগ দিয়েছিল। দলটির নেতা-কর্মীদের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তারা মনে করছেন এতে গণ অভ্যুত্থানকে অপমান করা হয়েছে, দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা হয়েছে। তাই এর প্রতিবাদে প্রতীকীভাবে দলকে শুদ্ধ করতে ৬ আগস্ট ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা এক মণ দুধ ঢেলে অফিসটি ধুয়ে দিয়েছেন। ঘটনাটি অভিনব সন্দেহ নেই। তা ছাড়া দুধ দিয়ে ধুয়ে দিলেই অপবিত্র কোনো কিছু পবিত্র হয়ে যায় কি না, তা-ও প্রমাণিত নয়। তারপরও অনেকেই এরকম করেন। দুধের পবিত্রতার প্রচলিত ধারণা থেকেই সম্ভবত এর উৎপত্তি। কালিয়াকৈরের ছাত্রদলকর্মীরা দলীয় অফিসকে শুদ্ধ করার যে চিন্তা করেছেন তা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। তবে দুধ দিয়ে শুধু অফিস ধুলেই তা পবিত্র বা শুদ্ধ হয়ে যাবে, এমনটি ভাবা আসলে ঠিক নয়। একটি দলকে শুদ্ধ করতে প্রয়োজন দলটির নেতা-কর্মীদের আত্মশুদ্ধির অনুশীলন। দল বা এর নেতা-কর্মীদের মনমানসিকতার শুদ্ধতা অর্জন দুধে ধুয়ে নয়, তা করতে হবে দলীয় আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা ও তা অনুসরণের দ্বারা।
এটা অস্বীকার করার জো নেই যে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে দেশের প্রায় সব কটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ আদর্শ বিচ্যুতির শিকার। তারা যতটা না আদর্শের চর্চা করে, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি করে নেতাদের পায়ে তৈলমর্দন ও ধান্দাবাজি। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা বিত্তবেসাত অর্জনের জন্য এমন কোনো পন্থা নেই যা অবলম্বন করেন না। এ ক্ষেত্রে নেতারাই তাদের পথপ্রদর্শক। একজন কর্মী যখন দেখেন, তিনি যাকে নেতা মানেন, তিনি অনৈতিক পথে দেদার আয় করছে, তখন সে ওই পথে যেতে অনুপ্রাণিত হয়। সদ্য বিগত সরকারটির অবস্থা দেখে এ সত্যটি সহজেই উপলব্ধি করা যায়। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি ও তার স্বজন-সুহৃদরা যেভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনে ব্যাপৃত থেকেছে, সেই প্রবণতা সারা দেশের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও ভাইরাসের মতো ছড়িয়েছিল। রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে যখন আদর্শের চর্চা কমে যায়, তখনই এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তাঁর এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘প্রশিক্ষিত কর্মীই একটি রাজনৈতিক দলের প্রাণ।’ তাঁর এ উক্তির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। তবে প্রশ্ন হলো তিনি কোন প্রশিক্ষণের কথা বলেছেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রেসিডেন্ট জিয়া রাজনৈতিক কর্মীদের আদর্শগত প্রশিক্ষণের কথাই বলেছেন। যেজন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিএনপির ‘রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। সেখানে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এ কে এ ফিরোজ নুন। মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সে কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। দলের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান অনেক সেশনে উপস্থিত থেকে পরীক্ষা নিয়েছেন প্রশিক্ষণার্থীদের। সে ব্যবস্থা এখন আর নেই। তবে দলে একজন প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক রয়েছেন। মাঝেমধ্যে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হওয়ার খবরও পাওয়া যেত। এখন আর তার বালাই নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক