তখন আমার বয়স আর কতই বা হবে, বড়জোর তিন অথবা চার। সময়টা পাকিস্তানি জমানার শেষকাল। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী টানটান উত্তেজনা গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছিল এবং আমাদের বয়সি শিশু কাম বালক-বালিকারাও অনেক কিছু টের পাচ্ছিল। রেডিওতে খবর হতো, বিশেষ করে বিবিসির খবর আর তা ছেলে-বুড়ো মিলে শুনত। আমার দাদি ছিলেন পুরো গ্রামের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং তৎকালীন জমানার স্মার্ট, অভিজ্ঞ ও অভিজাত। দাদির বাবা ছিলেন নামকরা জমিদার এবং তাঁর এক ভাই ছিলেন পাকিস্তান জমানায় পুলিশের আইজি। তাঁর অন্যান্য আত্মীয়স্বজন সরকারি চাকরিবাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য এবং রাজনীতি ও স্থানীয় মাতব্বরিতে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। ফলে আমাদের গ্রামের লোকজন দাদির কাছে আসতেন আর তিনি রীতিমতো মজমা মিলিয়ে গপসপ করতেন। তো একদিন গল্প করার সময় দাদি হঠাৎ বললেন, ‘দিয়ে ধন দেখে মন কাইড়া নিতে কতক্ষণ।’
আমি দূর থেকে কথাগুলো শুনলাম এবং ভয়ে আমার সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। আমাদের গ্রামে শিশুদের মধ্যে হাজাম আতঙ্ক ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চেয়েও বেশি। আর সুন্নতে খতনার নাম শুনলে শিশুমহলে মরণকান্না শুরু হয়ে যেত। আমার মধ্যেও উল্লিখিত দুটো আতঙ্ক ছিল। কিন্তু আমি সত্যিকার অর্থে তখনো জানতাম না যে হাজাম আসলে শিশুদের গোপনাঙ্গ কেটে নিয়ে কী করে। বিষয়টি ছিল টপ সিক্রেট এবং যাদের অঙ্গহানি করা হয় তারা কী পরবর্তীকালে মেয়ে হয়ে যায় নাকি অন্য কিছু- এসব নিয়ে শিশুরা একাকী ভাবত এবং আতঙ্কিত হতো। দাদির কথা শুনে আমার মনে হলো, আমি যে ঠিকমতো মক্তবে যাই না সময় পেলেই পাশের জঙ্গলে গিয়ে ভূতপ্রেত শয়তান খুঁজি- তা সম্ভবত দাদিকে যারপরনাই বিরক্ত করেছে। সেজন্য তিনি হয়তো হাজাম ডেকে আমার মহামূল্যবান সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
শৈশবের উল্লিখিত স্মৃতি-পরবর্তী জীবনে কতবার যে স্মরণ করেছি এবং কতবার সে খিলখিলিয়ে হেসেছি তার ইয়ত্তা নেই। তবে বুড়ো বয়সে আমি আমার শিশুতোষ নস্টালজিয়ার কারণে ইদানীং বারবার আতঙ্কিতবোধ করছি। বিশেষ করে দেশের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন দলবেঁধে মিছিল করা হয় এবং বড় বড় রাজনৈতিক নেতা এবং ভিন্নমতের লোকজনের পশ্চাৎদেশ আক্রমণ করে কওমে লুতের জমানার মতো কাণ্ড ঘটানোর প্রকাশ্য হুমকি দেওয়া হয় তখন আমার মনে নতুন করে সেই শৈশবের আতঙ্ক ভর করে। আমি বইপুস্তকে সমকামিতা, পুুরুষ বলাৎকার সম্পর্কে পড়েছি। বিশেষ করে খুশবন্ত সিংয়ের একটি বইতে তিনি সমকামিতাকে এত বিশ্রীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা স্মরণ করলে যে কোনো রুচিমান মানুষের সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠবে এবং প্রাকৃতিক কর্মের সময় খুশবন্ত সিংয়ের সেই বর্ণনা মনে হলে বর্জ্য ত্যাগ বন্ধ হয়ে যাবে।
দেশের চলমান রাজনীতি-অর্থনীতি, সন্ত্রাস-ছিনতাই-চাঁদাবাজি নিয়ে আমার যথেষ্ট আতঙ্ক রয়েছে। ফলে রাতবিরাতে বের হই না এবং দামি জামাকাপড়, নগদ অর্থ, ঘড়ি-কলম, মোবাইল ফোন নিয়ে দিনের বেলায় চলাফেরা করতেও ভয় লাগে। উপরন্তু আমার নরমশরম শরীর এবং সাম্প্রতিক জমানার পুরুষ বলাৎকারকারীদের মিছিল এবং বলাৎকারের হুমকির কারণে প্রায়ই আনমনা হয়ে স্থানকালপাত্র ভুলে অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটাই। এই যেমন ধরুন আজকের শিরোনামে যেখানে নীলা ইস্রাফিল নামের এক ভদ্রমহিলার আহাজারি, পূর্বাচলের নীলা মার্কেটের হাঁসের মাংসের বাহাদুরি এবং পাপিয়াকাণ্ড তথা হালফ্যাশনের হারাম টাকাওয়ালাদের বাইজি মহল হিসেবে ক্যুখ্যাতি পাওয়া পাঁচতারকা হোটেল ওয়েস্টিনের নাশতাকাণ্ড নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে আলোচনার কথা ছিল- তা না করে কী সব শৈশব স্মৃতি এবং শিক্ষালয়ে মিছিল করে বলাৎকারের হুমকি নিয়ে বলছি।
মানুষ যখন ভয় পায় অথবা মজলুম হয়ে পড়ে তখন তাদের আবেগ-অনুভূতি চিন্তাচেতনা ওলটপালট হয়ে যায়। তারা বর্তমান সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে এবং মাতাল বা মদ্যপের মতো আচরণ শুরু করে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহেও এই বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। কিয়ামতের ময়দানে এমন এক ভীতিকর ও ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হবে, সবাই মাতালের মতো ছোটাছুটি করবে এবং চিৎকার-চেঁচামেচি করে সাহায্যের জন্য আকুতি জানাতে থাকবে। মানুষের পার্থিব ভয় প্রবল হলে তারা শুধু বর্তমানকে ভুলে যায় না, তারা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। কিছু মানুষ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাদ দিয়ে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে পছন্দ করে। আজ আমার কী হয়েছে, তা বলতে পারব না। চলমান বাংলাদেশের অনেক কিছু দেখছি, কিন্তু ভাবতে পারছি না যে এসব কেন হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে অথবা এসব কর্মের ভবিষ্যৎ পরিণতি কী? কিছু লোককে দেখছি যাদের আগে দেখিনি- কিছু কাহিনি শুনছি, যা আগে কখনো শুনিনি আর কিছু ঘটনা ঘটছে, যা আগে কল্পনাও করা যেত না। সুতরাং বর্তমান সময়ের পাগলাঘণ্টার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটাছুটির পরিবর্তে চলুন আমার শৈশবের স্মৃতিবাড়ি থেকে আপনাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
আমার দাদা বলতেন, টাকা এত শক্তিশালী এবং এতই আকর্ষণীয় যে মাটির পুতুলের সামনে টাকার বান্ডিল রাখলে সেই পুতুল টাকা খাওয়ার জন্য কুমিরের মতো হা করে। দাদার সেই গল্প আমি ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ভুলে ছিলাম। কিন্তু গত এক বছরে যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে, মাটির পুতুল শুধু টাকা খায় না বরং টাকা খেয়ে একেকটি পুতুল হিটলার-মুুসোলিনি, চেঙ্গিস-তৈমুর হয়ে বর্গির বেশে উনসত্তর হাজার গ্রামগঞ্জ আর শহর তছনছ করার জন্য উসখুস শুরু করে। মাংসলোভী বর্গির দল যেসব লঙ্কাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তার সামান্য অংশ লোকজন জানতে পারছে আর তাতেই চারদিকে ছি ছি রব শুরু হয়েছে- কিন্তু পর্দার আড়ালে যেসব ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে, তা জানাজানি হলে মানুষ কেয়ামতের ময়দানের মতো মাতালের বেশে হাহাকার এবং আহাজারি শুরু করে দেবে।
রাজনীতিতে ব্লু ব্লাড থিওরি হাজার হাজার বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত একটি মতবাদ। রাজনীতি করার জন্য ভালো রক্ত অর্থাৎ যেসব লোকের শত শত বছরের পারিবারিক ইতিহাসে চুরি-ডাকাতি, খুনখারাবির মতো অপরাধ নেই এবং যারা বংশপরম্পরায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য নিজের জীবনযৌবন, ধনসম্পদ উজাড় করে দেয় তারাই রাজনীতির নীল রক্তের ধারক এবং তাদের হাতেই রাজনীতি-রাষ্ট্র নিরাপদ। যেসব দেশের রাজনীতিতে নীল রক্তের প্রবাহ বেশি থাকে, সেসব দেশই পৃথিবীর বুকে সভ্যতাভব্যতা, বিজ্ঞান-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নিত্যনতুন মাইলফলক স্থাপন করে।
অন্যদিকে যারা ফকির-মিসকিন দিয়ে রাজদরবার ভরপুর করে এবং চোর-গুন্ডা, বদমাশ-ঘুষখোর, জেনাকার, ব্যভিচারীদের আমির-ওমরাহ বানিয়ে রাজকর্ম চালায়, তারা নিজেদের যত বড়ই মনে করুক না কেন দেশবাসী তাদের কোনো দিন সম্মান প্রদর্শন করে না বরং সময়সুযোগ পেলে অপমান-অপদস্থ এবং নাজেহাল করতে একটুও কার্পণ্য করে না। কথায় আছে, রাজার কাজ প্রজা দিয়ে হয় না। সুতরাং রাজকর্মে দরিদ্র ও অভাবিরা সুযোগ পেলে তারা রাজকোষের সর্বনাশ ঘটাবে। তারা প্রথম দিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেদের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সময় যেসব লোভলালসা দ্বারা তাড়িত হতো তা চরিতার্থ করে, তারপর তাদের রুচির বিকৃতি ঘটে এবং চরিত্রহীনতার প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হওয়ার জন্য জেনা-ব্যভিচার, মদ, জুয়া, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন, সম্মানিত ব্যক্তিকে অসম্মান, অসহায়দের ওপর জুলুম ও নির্যাতন করার পাশাপাশি তাদের চেয়ে যারা শক্তিশালী তাদের কাছে মস্তক অবনত করে স্বার্থের জন্য এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিজেকে সমর্পণ করে। এ ক্ষেত্রে তাদের দ্বৈত চরিত্র অর্থাৎ শক্তের ভক্ত নরমের যম সূত্র প্রতিদিন অনুসরণ করতে গিয়ে তারা জমিনের জন্য এতটা ভয়ংকর, এতটা নিকৃষ্ট এবং এতটা ঘৃণিত হয়ে পড়ে যে জমিন তাদের ভার বহন করতে চায় না। তাদের দেখলে প্রকৃতি অভিশাপ দিতে থাকে এবং প্রকৃতির অভিশাপে হঠাৎ একদিন তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক