তরুণ বয়স, জীবন উপভোগের শ্রেষ্ঠতম সময়। যে কোনো প্রাণী বিশেষ করে মানুষের জীবন উপভোগের সবচেয়ে মোক্ষম সময় আসে তরুণকালে। সংসার, দেশ, সমাজের কাছে এ সময় তাদের কোনো দায়দায়িত্ব থাকে না। বয়স দূরত্বের ১৮ থেকে ৩০ বছর সময়কালে সবচেয়ে সুখময় সময় অতিবাহিত হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ৫০ প্লাস বয়সি মানুষেরা কেন যেন তরুণদের চেয়ে সহজ-সাবলীল সময় অতিবাহিত করছেন বলে মনে হয়। একটা সমীক্ষা দাবি করেছে, তারুণ্য নয়, পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সিরা বর্তমান সময়ে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে সময় পার করেন।
দেশ এবং বিশ্বের সব তরুণ নিজের ওপর নয়; বরং মোবাইল, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বাড়বাড়ন্তভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই মোহগ্রস্ততার কারণে সুন্দর এই বয়সে জেঁকে বসেছে বিষণ্নতা- এক গবেষণা দাবি করছে। ওই গবেষণায় মন্তব্য এসেছে, ইন্দোনেশিয়ার খাদ্যমন্ত্রী বৃদি গুনাডি সাদিকিন ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে বলেছিলেন, তাঁর দেশের প্রতি ১০ জন তরুণের মধ্যে একজন মানসিক রোগী এবং তা এই মোহময়তার কারণে। তাঁর মতে, এই অস্থিরতার ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রথমত কেবল অস্থিরতা এবং অস্বস্তিজনিত কারণ। দ্বিতীয়ত হলো, বিষণ্নতা এবং তৃতীয়ত হচ্ছে, ভগ্নমনস্কতা বা যুক্তিহীনতা।
তবে তারুণ্য উগ্রতার আরও কারণ রয়েছে বলে দাবি করেছে অন্য এক গবেষণা। তাদের ধারণা পারিবারিক আর্থিক দৈন্য, জীবন পরিচালনায় কোনো কষ্টকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত বিষয়, সামাজিক বৈষম্যের কারণে তরুণ সমাজ আর্থিক এবং সামাজিক বিভেদের শিকার। এ কারণে আমাদের তরুণরা পরিবার, সমাজ, পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন। তারা প্রতিবেশীদের তেমন চিনে না। আত্মীয়স্বজনকে পুরোপুরি সম্পর্কের বন্ধনে ধরে রাখতে পারে না। এর সঙ্গে আরেকটি কারণ হলো, জলবায়ুগত পরিবর্তন, যা বর্তমান সময়ের আলোচিত সমস্যা বটে।
এই পরিবর্তন আমাদের যুব প্রজন্মের ভিতরে মানসিক অশান্তি, উদ্বেগ এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত পথে যেতে বাধ্য করছে। এজন্য এই মানব প্রজন্মের একটা অংশ সম্পদ না হয়ে অনেকাংশে বোঝা হয়ে পড়েছে। মোট মানুষের মধ্যে এক বিরাট অংশ আমাদের যুব বা তারুণ্যের অহংকার। এদের পুরোপুরি সম্পদে পরিণত করা গেলে আমাদের শ্রমশক্তি বাড়বে। আমাদের উৎপাদন বাড়বে। দেশের অস্থিরতা কমবে। পরিবার থেকে সমাজ বলিষ্ঠ শক্তি ও বুদ্ধি বা কৌশল দিয়ে দেশকে পরিচালিত করতে পারবে। সে কারণে এই উদ্যোগের পটভূমি এবং কর্মসাধনে প্রথমে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে পরিকল্পনা তৈরি করে। এ ছাড়া যুব সম্প্রদায়ের জন্য মানবিক সুস্বাস্থ্য পরিকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। যেন তারা তাদের খারাপ চিন্তা পরিহার, স্বভাবগত পরিবর্তন এবং সংস্কৃতি বিনিময় রোল প্লেতে বিভিন্ন তরুণ তাদের ভাববিনিময়ে সৌহার্দ্যরে পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট, মোবাইলের পজিটিভ ব্যবহার করতে সরকারকে কাজ করতে হবে। তারুণ্যের জয়গানে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা রয়ে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের সোশ্যাল মিডিয়ার সঠিক ব্যবহারের প্রতি অভ্যস্ত করতে উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের তাদের ‘লাইফ স্কিল’ তৈরিতে শিক্ষাদান করতে হবে। এ বিষয়ে বাধ্যবাধকতা থাকা আবশ্যক। যুব প্রজন্মকে বিশেষ উদ্যোগে তাদের আয়-ব্যয় এবং এতদ্বিষয়ে নিজেদের সংগতিপূর্ণ বাজেট তৈরি, সঞ্চয়, বিনিয়োগীকরণ বিষয়ে বাধ্যতা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের তারুণ্য বা যুবশক্তির একটা অংশ আজ নেশা, নেট ডিভাইসে গভীর আচ্ছন্ন। যেজন্য তারা সামাজিক অনাচারে শক্তির অপব্যবহার করে চলেছে। তারা স্রেফ আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবের। তারা সামাজিক প্রথায় সৌম্য ও সম্প্রীতির বিপরীতে চলে। অন্যের ইচ্ছে পূরণে তাদের শক্তি ব্যবহার হয়ে থাকে।
সামাজিক ও মানবিক বিষয়ে তারা উদাস দৃষ্টিভঙ্গির। লেখাপড়ায় তারা পরীক্ষার্থী মনোভাবের। তারা একমুখী শিক্ষাগ্রহণ করে এবং একমুখী ভাবনায় চলে। পরিবার এবং সমাজ বা আত্মীয়স্বজনের কাছে তাদের কর্তব্য কিংবা দায়বদ্ধতার বালাই পর্যন্ত নেই। তারা জীবনমুখী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। বিশ্বের যে কোনো দেশের মানবসম্পদের মধ্যে তারুণ্য সম্পদের মূল্য সবচেয়ে বেশি। আমাদের জাতীয় উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে এই শ্রমশক্তির বিন্যাস ফলদায়ক। সুতরাং এই সম্পদ ও শক্তি বিকাশে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই শক্তির ব্যবহার ব্যর্থতা আমাদের পরিবার, সমাজ হয়ে রাষ্ট্র পর্যন্ত স্পর্শ করলে তা পুনরুদ্ধার করা আদৌ সম্ভব হবে না। যুব বয়সের শুরুতে তারা ডিজিটাল হয়, তারপর দিনে দিনে তারা হয়ে ওঠে ক্রিটিক্যাল। তারুণ্যের জ্যোতি শেষ হলে তাদের মাথা টাল হয়ে ওঠে। তখন তাদের চোখের সামনে সবকিছুই ধূসর মনে হয়। জীবন তিক্ততায় এঁরা অসময়ে নিজেদের শেষ করে দিতেও কুণ্ঠা বোধ করে না। কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো পথে পা বাড়ায়।
লেখক : পরিবেশ গবেষক