ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ছিলেন দেশটির রেলমন্ত্রী। ঘটনাটি সে সময়ের। শাস্ত্রীর মা দিল্লিতে যাবেন পুত্রের কাছে। তিনি বসে আছেন রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। রাত হয়ে গেছে, স্টেশন জনশূন্য। পরের ট্রেন আসবে পরদিন সকালে। বৃদ্ধার সেটা জানার কথা নয়। এক কুলি তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাইজি তুমি কোথায় যাবে?’ বৃদ্ধা বললেন, ‘আমি দিল্লিতে যাব বাবা, আমার ছেলের কাছে।’ কুলি বললেন, ‘মাইজি আজ তো আর ট্রেন নেই, চল তোমাকে ওয়েটিং রুমে রেখে আসি।’ বৃদ্ধাকে সাহায্য করা যায় কি না, ভেবে কুলি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মা, দিল্লিতে তোমার ছেলে কী কাজ করে? দেখি যোগাযোগ করা যায় কি না।’ বৃদ্ধা জবাব দিলেন, ‘শুনেছি রেলে কী একটা কাজ করে।’ কুলি ছেলের নাম জিজ্ঞেস করলে বৃদ্ধা বললেন, “ও তো আমার লাল। সবাই ওকে ‘লাল বাহাদুর শাস্ত্রী’ বলে ডাকে যে!” পুরো রেলস্টেশনে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। স্বয়ং রেলমন্ত্রীর মা অসহায় অবস্থায় রেলস্টেশনে পড়ে আছেন, চাকরি বুঝি আর কারও থাকে না! সবাই তৎপর হয়ে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে এলো একটি সেলুন কার। বৃদ্ধা তো অবাক! তাঁর ছেলের এত ক্ষমতা! দিল্লিতে পৌঁছে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন-‘ব্যাটা, তু রেলমে ক্যায়া কাম করতা হো? উস্ লোগ পুছা তো ম্যায়নে কুছ নেহি বোলপায়া!’ মুচকি হেসে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী জবাব দিলেন, ‘ছোটি সি কাম মা।’
ঘটনাটির দুটি অসাধারণ দিক হলো, ভারতের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মা জানতেন না তাঁর ছেলে সে দেশের রেলমন্ত্রী। আর শাস্ত্রী তাঁর মন্ত্রিত্বকে বিবেচনা করেছেন, ‘ছোট্ট কাজ’ হিসেবে। বিষয়টি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটু চিন্তা করে দেখা যাক। আমাদের দেশের রেলমন্ত্রীর কোনো স্বজন যদি ট্রেনে চড়ে কোথাও যেতে চান, তাহলে সপ্তাহখানেক আগেই তার জন্য ভিভিআইপি কেবিন রিজার্ভ হয়ে যায়। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রী ও শ্যালক-শ্যালিকাদের টিকিট চেক এবং বিনা ভাড়ায় রেল ভ্রমণে বাধা দেওয়ায় টিকিট চেকার থেকে শুরু করে স্টেশন মাস্টার পর্যন্ত রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কী ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল, সে কাহিনি আমরা পত্রিকায় পড়েছি। পার্থক্যটা এখানেই। যেসব রাজনীতিবিদ নিজেদের দেশ ও জনগণের খেদমতগার মনে করেন, তাদের স্বজনরাও থাকেন সংযত। ক্ষমতাশালী স্বজনের প্রভাব-প্রতিপত্তির অপব্যবহার করে ফায়দা লোটার রোগ তাদের আক্রান্ত করতে পারে না। সেজন্যই তারা বড় কাজের দায়িত্বে থাকলেও নিজেকে ‘সামান্য কর্মী’ হিসেবেই বিবেচনা করেন। কিন্তু যারা নিজের কিংবা স্বজনের ক্ষমতা ব্যবহার করে আত্মস্বার্থসিদ্ধির চিন্তা করেন, তারা ছোটখাটো কোনো দায়িত্ব পেলেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ভাবতে থাকেন।
বাংলা ভাষায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ, ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়’। ‘দড়’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘শক্ত’। এ প্রবচনের দ্বারা মূল গাছের চেয়ে শাখা-প্রশাখার শক্ত হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। এটি একটি নেতিবাচক প্রবচন। কেননা মূল গাছের চেয়ে শাখা-প্রশাখা কখনোই শক্ত হতে পারে না। সাধারণত মূল ব্যক্তির চেয়ে তার সঙ্গী-সাংগাত বা আত্মীয়-পরিজন যখন নিজেদের অধিকতর ক্ষমতাবান হিসেবে জাহির ও ফায়দা ওঠানোর চেষ্টা করে, প্রবচনটি তখনই ব্যবহার হয়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ প্রবচনটির উদাহরণ রয়েছে বিস্তর।
স্বজনদের অপকর্মের কারণে দেশের অনেক বড় বড় নেতার জনপ্রিয়তায় ধস নামার নজিরের অভাব নেই। অনেক নেতার পতন ঘটেছে কিংবা ত্বরান্বিত হয়েছে সে কারণে। স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জনপ্রিয়তায় হিমালয়। তার ভাবমূর্তি ছিল আকাশচুম্বী। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাই বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ দুঃখজনক হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছিল তাঁর স্বজন-সুহৃদদের কারণেই। সে সময় তাঁর স্বজন-পরিজনের মধ্যে ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির দাপট ছিল কোনো কোনো ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বেশি। স্নেহান্ধত্বের কারণেই হোক কিংবা প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে, তিনি তাঁর এ ভাগনেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। বরং বলা যায়, নিজেই ভাগনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়েছেন অনেক সময়। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে নানা রকম চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। আর সেটা তিনি করেছিলেন ‘আমি শেখ মুজিবের ভাগনে’-এ পরিচয় ব্যবহার করেই। সেসব ঘটনার বিশদ বিবরণ রয়েছে তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা-৭১’ গ্রন্থে। দেশ স্বাধীন হলো, বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদকে নাস্তানাবুদ করতে শেখ মণি প্রতিনিয়ত কান ভারী করতে থাকেন মামা প্রধানধান্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক তাজউদ্দীন আহমদকে দুই বছরের মাথায় মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়।
স্বজনদের কানকথা কানে তোলার প্রবণতা দেশের রাজনীতিকদের অনেকের রয়েছে। এ কুপ্রবণতার কারণে তাঁরা যেমন বিপাকে পড়েন, তেমনি নির্দোষ কোনো কোনো ব্যক্তি অপরাধ না করেও শস্তি পান। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি যত দিন বেঁচেছিলেন, তত দিন কে তাঁর ভাই, কে তাঁর শ্যালক, কেউ জানতে পারেনি। এমনকি তখন তাঁর পত্নীর নামটিও অনেকেরই জানা ছিল না। ‘ফার্স্ট লেডি’ হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া দেশে কিংবা বিদেশে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সফরসঙ্গী হলে রেডিও-টিভি-সংবাদপত্রের খবরে বলা হতো ‘রাষ্ট্রপতির পত্নী বেগম জিয়া সফরসঙ্গী ছিলেন।’ জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)-এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী আমাকে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ছোট ভাই আহমদ কামালের সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। আহমদ কামাল বাসাবোর একটি মেসে থাকতেন। কিন্তু মেসের কেউ জানতেও পারেনি আহমদ কামাল প্রেসিডেন্টের ভাই। একসময় ভাই জিয়াউর রহমানের বাসায়ই থাকতেন তিনি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পর জিয়াউর রহমান ছোট ভাইকে বলে দিয়েছিলেন, ‘আমি এখন রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। এখন থেকে তুমি অন্যত্র থাকবে। আমি চাই না আমার পরিচয় ব্যবহার করে তোমরা সুবিধা আদায় কর।’ পরে নিজের যোগ্যতায় আহমদ কামাল পর্যটন করপোরেশনে চাকরি পেয়েছিলেন। চাকরি পেতে বা প্রমোশনের জন্য বড় ভাইয়ের প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যবহারের চিন্তাও করেননি। করলে হয়তো চাকরিটাই থাকত না।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের একটি বড় গুণ ছিল, তিনি নিজেকে দেশের খাদেম ভাবতেন। যার ফলে তাঁর আত্মীয়স্বজনরা কোথাও ক্ষমতা প্রদর্শনের চিন্তাও করেনি। একটি ঘটনা শুনেছিলাম তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র, বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মুখে। জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রপতি, নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীরবিক্রম শাহদেব ও রানি ঐশ্বর্যলক্ষ্মী দেবী এসেছিলেন বাংলাদেশ সফরে। সঙ্গে ছিল তাঁদের দুটি ছেলেমেয়ে। এরপর ফিরতি সফরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সস্ত্রীক যাবেন নেপালে। প্রস্তুতি চলছে। তারেক সাহেব ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে সলাপরামর্শ করে এক সকালে গিয়ে মা খালেদা জিয়াকে বললেন, ‘আম্মু, নেপালের রাজা-রানি তো তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমাদের দেশে এসেছিলেন, তাহলে তোমরা আমাদের নিয়ে যাচ্ছ না কেন?’ বেগম খালেদা জিয়া পুত্রকে ‘প্রশ্নটা ঐখানে কর’ বলে দরজার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। তারেক রহমান তাকিয়ে দেখলেন পিতা জিয়াউর রহমান দরজায় দাঁড়িয়ে, তিনি অফিসে যাচ্ছেন। পুত্রের প্রশ্নের উত্তরে পিতার জবাব ছিল, ‘তোমরা তো রাজার ছেলে নও। রাষ্ট্র তোমাদের খরচ বহন করবে কেন?’ ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করলাম, কারণ পৃথিবীতে কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ জন্মান, যাঁরা নিজেদের রাজা-বাদশাহ মনে করেন না। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ইচ্ছা করলে তাঁর পুত্রদ্বয়কে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু নেননি। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তাঁর মায়ের কাছে যেমন মন্ত্রিত্বকে ‘ছোটি সি কাম’ বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াও তারেক রহমানকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর পিতা রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট; দেশের রাজা অর্থাৎ মালিক নন।
অথচ আজকাল নেতাদের দেখি তাঁরা কেউ এমপি কিংবা মন্ত্রী হলে নিজেকে গোটা তল্লাটের জমিদার মনে করেন। তখন তাঁর স্বজন-সুহৃদরা হয়ে ওঠেন একেকজন মহাপরাক্রমশালী। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কৌতুক নকশায় ঘটক গিয়েছে একজনের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। মেয়ের মা জিজ্ঞেস করলেন, পাত্র কী করে? ঘটক জবাব দিল, ছেলে হইল ‘নেতার হাতা’। বিস্মিত মেয়ের মা বলল, নেতার হাতা মানে? ঘটক দাঁত বের করে বলল, ‘নেতাদের অনেক চামচা থাকে তো! এই ছেলে চামচাদের চেয়ে একটু বড়, তাই সে হাতা। তার হাত ছাড়া নেতা কোনো কাজই করে না!’ নেতাদের এসব হাতার দেখা সর্বত্রই পাওয়া যায়। এদের দাপট ‘সূর্যের চেয়ে বালু গরম’ প্রবাদের সঙ্গে তুল্য। হয়তো কোনো একজন কোনো একটি বড় দলের থানা পর্যায়ের একটি মাঝারি পদ পেয়েছে। অমনি তার স্বজনদের দাপটে কাঁপতে থাকে সে এলাকার মাটি। শুধু কি মাটি? সেই সঙ্গে কাঁপে সাধারণ মানুষের অন্তরাত্মাও। কারণ নেতাদের এসব হাতার হাত অনেক লম্বা হয়। তারা তাদের দীর্ঘ ও শক্তিশালী হাত দিয়ে যে কারও যা কিছু ইচ্ছা ছিনিয়ে নিতে পারে। প্রতিবাদ করলে সেই হাত দিয়েই প্রতিবাদীর গলা টিপে ধরতে পারে। নেতাদের হাতার হাত কতটা লম্বা হতে পারে তার একটি ছোট্ট উদাহরণ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসার চাকর জাহাঙ্গীর। শেখ হাসিনা নিজেই সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করেছিলেন, তাঁর বাসার কাজের লোক ৪০০ কোটি টাকার মালিক। সে হেলিকপ্টার ছাড়া চলাফেরা করে না। লোকজন অবশ্য তখন আড়ালে-আবডালে এই বলে টিপ্পনী কেটেছিল, চাকর যদি ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়, তাহলে মনিবের সম্পদের পরিমাণ কত? তবে সংগত কারণেই সে সময় তা অনুসন্ধান বা প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। এখন অবশ্য থলের বিড়াল ঠিকই বেরিয়ে আসছে।
ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মা জানতেন না তাঁর ছেলে দেশের মন্ত্রী। কেন জানতেন না? কারণ শাস্ত্রী তা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। আর আমাদের দেশে কেউ সরকার বা কোনো দলের একটি পদ পেলে তাঁর স্বজন-সুহৃদরা রীতিমতো পত্রিকা কিংবা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে গোটা দেশের মানুষকে জানিয়ে দেন। সঙ্গে নিজেও হয়ে যান ক্ষমতায়িত। দুর্ভাগ্যের বিষয় লাল বাহাদুর শাস্ত্রী কিংবা জিয়াউর রহমানের মতো নেতা যে কোনো দেশেই খুব কমই আসে।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক