বৈষম্যের শিকার হলে মানুষ আদালতে বিচারপ্রার্থী হয়। বিচারক বিস্তারিত শুনে এক পক্ষে রায় দেন। বিচারকের রায়ে কেউ জেতে কেউ ঠকে। বিচারক যদি সঠিক বিচার করেন, তাহলে আল্লাহর কাছে তিনি সম্মানিত হবেন। আর যদি অন্যায় রায় দেন তাহলে কেয়ামতের দিন কঠিন আজাব তার জন্য নির্ধারিত। সঠিক বিচার করার জন্য চাই পরিষ্কার বুঝ শক্তি। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম বিষয় পর্যবেক্ষণ করে সত্য বের করে আনার জন্য বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন। এ দক্ষতা বিভিন্ন ট্রেনিং, উচ্চতর পড়াশোনার মাধ্যমে অর্জিত হয়। এর বাইরেও আল্লাহ কিছু মানুষকে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণশক্তি দিয়ে থাকেন। যার মাধ্যমে সহজেই ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য করা যায়। আল্লাহর নবী সোলাইমান (আ.) ছিলেন বিশেষ সূক্ষ্ম জ্ঞানীদের একজন। তাঁর পিতা হজরত দাউদ (আ.)-ও নবী ছিলেন। ছিলেন বাদশাহ ও বিচারক। তবে বিচারের ক্ষেত্রে পুত্র ছিলেন পিতার চেয়ে বেশি সূক্ষ্মদর্শী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ কর দাউদ ও সোলাইমানের কথা! একজনের মেষের পাল রাতে অন্যের খেতে ঢুকে ফসল নষ্ট করার মামলার বিচার যখন তারা করছিল, আমি তাদের বিচার পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমি তখন সোলাইমানকে সঠিক ফয়সালা বুঝিয়ে দিলাম। নিশ্চয়ই আমি তাদের দুজনকেই দিয়েছিলাম জ্ঞান ও প্রজ্ঞা (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)।’ ইসলামি বিচারব্যবস্থা নিয়ে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি গবেষণা করেছেন ভারতের প্রখ্যাত আলেম ড. জিয়াউর রহমান আজমী। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘আকদিয়াতে রসুল (সা.) বা রসুলের (সা.) বিচারব্যবস্থা।’ গবেষণা শেষে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন। বিচারকের জন্য জরুরি জ্ঞান আলোচনা করতে গিয়ে প্রথম তিনি এ পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, বিচারকের জন্য পর্যবেক্ষণজ্ঞান খুবই দরকারি বিষয়। এ পর্যবেক্ষণজ্ঞান অর্জনের জন্য নবী বা অলি হওয়া শর্ত নয়। সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী যে কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি ধীরে ধীরে সাধনার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণশক্তি বাড়াতে পারে। যুক্তি হিসেবে তিনি হজরত ইউসুফ (আ.)-এর বাল্য বয়সের ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পর্যবেক্ষণশক্তির ফলেই সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে ইউসুফ (আ.) নির্দোষ এবং জুলেখা দোষী। আল্লাহ বলেন, ইউসুফ বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘আমি নই, সে-ই চাচ্ছে আমি তার সঙ্গে কুকর্মে লিপ্ত হই!’ ঘটনার সত্যাসত্য নিরূপণের জন্য মহিলার পরিবারের একজন সদস্য বলল, ‘আসলে বিষয়টি সহজ। যদি কাপড় সামনে থেকে ছেঁড়া থাকে, তাহলে মহিলা সত্য বলছে এবং ইউসুফ মিথ্যা বলছে। আর যদি কাপড় পেছন থেকে ছেঁড়া থাকে, তবে মহিলা মিথ্যা বলছে, ইউসুফ সত্য বলছে (সুরা ইউসুফ, আয়াত ২৬-২৭)।’
একটি বিখ্যাত হাদিস থেকে জানা যায়, রসুল (সা.) যখন মুয়াজ (রা.)-কে ইয়েমেনের শাসক নিযুক্ত করেন তখন বিচারকাজের পদ্ধতি সম্পর্কে রসুল (সা.) জানতে চান। রসুল (সা.) জিজ্ঞেস করেন, তুমি কীভাবে বিচার করবে? মুয়াজ (রা.) বলেন, আল্লাহর কিতাব দিয়ে। রসুল (সা.) বলেন, কিতাবে সে সমাধান না পেলে তুমি কী করবে? মুয়াজ (রা.) বলেন, তাহলে রসুলের সুন্নাহ দিয়ে আমি ফয়সালা করব। রসুল (সা.) জানতে চান যদি সেখানেও সমাধান না পাও তাহলে কী করবে? জবাবে মুয়াজ বলেন, আমি আমার পর্যবেক্ষণশক্তি কাজে লাগিয়ে বিচার করব। এ জবাব শুনে রসুল (সা.) অত্যন্ত খুশি হলেন এবং বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ এমন একজনকে রসুলের প্রতিনিধি করেছেন, যে রসুলের নির্দেশ অনুযায়ীই ফয়সালা করবে (আবু দাউদ, হাদিস ৩৫৯২ এবং তিরমিজি, হাদিস ১৩২৭)।’ একই দৃষ্টান্ত দেখা যায় হজরত ওমর ও আবু মুসা আশআরীর ক্ষেত্রেও। হজরত ওমর যখন মুসলিম বিশ্বের খলিফা ছিলেন তখন আবু মুসা আশআরী কুফা অথবা বসরার প্রশাসক ছিলেন। বিচারকার্য পরিচালনার মূলনীতি উল্লেখ করে খলিফা ওমর একটি জ্ঞানগর্ভ চিঠি লিখেন। যে চিঠি আজও ইসলামি আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওমর (রা) লেখেন, ‘তোমার কাছে যদি কোনো মকদ্দমা আসে আর তার ফয়সালা যদি কুরআন সুন্নাহয় না পাওয়া যায় তাহলে তোমার পর্যবেক্ষণশক্তির সাহায্যে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবে।’ এ বর্ণনার আলোক ইমাম ইবনে কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা মানুষকে যত নেয়ামত দান করেছেন, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত হলো পর্যবেক্ষণশক্তি ও মহত্তম জীবনোদ্দেশ্য। এ দুটি বিষয়ের চেয়ে বড় কোনো দান মানুষের জীবনে নেই। যে এ দুটি সম্পদ পেয়েছে, তার অন্য কিছু না পেলেও চলবে। কেননা এ দুটি হলো ইসলামের সুদৃঢ় স্তম্ভ। এর ওপর ভর করেই ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে।’ আল্লাহতায়ালা আমাদের ব্যক্তিজীবনে পর্যবেক্ষণশক্তি বাড়িয়ে দিন। পাশাপাশি আমাদের সমাজের যারা নেতৃস্থানীয়, যারা দেশের অগ্রনায়ক এবং সব পর্যায়ের বিচারকাজের সঙ্গে যারা জড়িত, সবার মন ও মানসে আল্লাহর ভয়, সঠিক পর্যবেক্ষণশক্তি জাগিয়ে দিন। আমিন।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট