প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস উদযাপন করে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। সে হিসেবে এ বছর আজ ১১ মে বিশ্ব মা দিবস। ১৯০৭ সালের ১২ মে প্রথমবার আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন শহরে ‘মাদার্স ডে’ বা মা দিবস পালিত হয়। মা হচ্ছেন সন্তানের জন্য পথ চলার সাথি, শিক্ষক, বন্ধু, অভিভাবক সবকিছু। মানেই স্নেহের পরশ, ভালোবাসার পরশ। সবকিছু সন্তানের জন্য বিলিয়ে দেওয়ার নামই যেন মা। মা শাশ্বত, মা চিরন্তন। মা নিরাপদ আশ্রয় ও ভরসার স্থান। মা সব সন্তানের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্বার্থ ব্যক্তি, যিনি তার সন্তানদের পৃথিবীতে আসার আগেই ভালোবাসতে শুরু করেন। মা তার সন্তানের জন্য দেবদূতের মতো, যিনি সর্বদা সন্তানকে ভালোবাসেন এবং সমর্থন করেন। মা নামের ছোট্ট শব্দটার বিশালতা আকাশছোঁয়া। মায়ের স্নেহধারায় সিক্ত হয়ে গড়ে ওঠে প্রতিটি সন্তান। মায়ের আশীর্বাদ সন্তানকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করে। একমাত্র মা-ই পারেন সন্তানের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে। মায়ের অনুপ্রেরণা পথ দেখায় সন্তানকে। যারা শৈশবেই পিতৃহারা হন, মায়ের মমতা আরও বেশি স্পর্শ করে তাদের হৃদয়। ছোটবেলা থেকেই মায়ের প্রেরণা, ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা এবং আদর্শিক দিকনির্দেশনা বদলে দেয় সন্তানের পথচলা, আলোকিত করে তার আগামীকে। এভাবেই মায়ের অনুপ্রেরণায় বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করে গোটা পৃথিবী আলোকিত করেছিলেন টমাস আলভা এডিসন। এ ছাড়াও সফল বিজ্ঞানী হিসেবে গ্রামোফোন, ভিডিও ক্যামেরাসহ আরও অনেক যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। আধুনিক শিল্পায়নের যুগান্তকারী উন্নতি ঘটেছিল তাঁর হাত ধরেই। ছেলেবেলা থেকেই কৌতূহলী মন নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন আলভা এডিসন।
লেখাপড়ায় বেশ দুর্বল ছিলেন এডিসন। স্কুলে পড়াকালীন একবার পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ করায় চিঠি দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। তিনি যে খারাপ কিছু করেছিলেন তা অনুমান করতে পেরে চিঠিটি দেখিয়েছিলেন মাকে। চিঠি পেয়ে মা কী জানি ভাবছিলেন সজল দৃষ্টিতে! তারপর এডিসনের সামনেই উচ্চৈঃস্বরে পড়তে লাগলেন চিঠিটা। ‘আপনার পুত্র খুব মেধাবী, এই স্কুলটি তার জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মতো যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। দয়া করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।’ চিঠির কথা শুনে এডিসনের চোখ ভরে উঠেছিল অশ্রুতে। তখন থেকে মায়ের কাছেই শিক্ষা শুরু করলেন তিনি। এরপর অতিবাহিত হয়েছে অনেক বছর। টমাস আলভা এডিসন হয়ে ওঠেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, শিল্পপতি এবং মার্কেটিং জগতে সফল উদ্যোক্তা। তখন আর জীবিত ছিলেন না মা। নিজের চোখে দেখে যেতে পারেননি সন্তানের আকাশছোঁয়া সাফল্য, বিশ্বজোড়া খ্যাতি। একদিন কী এক কাজে পুরোনো কাগজ নাড়াচাড়া করছিলেন এডিসন। ভাঁজ করা এক কাগজের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ল তাঁর। হাত বাড়িয়ে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন সেটি। কাগজটি পড়তে পড়তে তিনি সেদিন ফিরে গিয়েছিলেন বহু বছর আগে স্কুল থেকে পাঠানো সেই চিঠিতে। সেটা পড়তে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল অদ্ভুত এক অনুভূতির! গভীর এক ব্যথায় তাঁর বুকে ভেসে গিয়েছিল চোখের জলে। সেই চিঠিতে লেখা ছিল- ‘আপনার সন্তান স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন, সে এই স্কুলের উপযুক্ত নয়, আমরা কোনোভাবেই তাকে আমাদের স্কুলে আর আসতে দিতে পারি না।’ তারপর এডিসন তাঁর ডায়রিতে লেখেন, ‘টমাস আলভা এডিসন একজন স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন শিশু ছিলেন। একজন আদর্শবান মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি শতাব্দীর সেরা মেধাবী হয়ে ওঠেন।’
ইউনিভার্সিটি অব এসেক্সের একজন অধ্যাপক এরিকা র্যাসকন একটি গবেষণা চালিয়েছেন, যেখানে প্রমাণিত হয়েছে যে কঠোর মায়েদের সন্তানরা সাফল্যে পরিপূর্ণ। র্যাসকনের মতে, শৈশব থেকেই সন্তানের পড়াশোনার ব্যাপারে পিতা-মাতার উচ্চাকাক্সক্ষা ও বিশ্বাস তাদের খ্যাতির চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। যেসব শিশুর মায়েদের উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল তারা বর্তমানে অধিক আত্মবিশ্বাসী ও নিরাপদ। গবেষণায় এটিও প্রমাণিত হয়, যেসব মেয়ের মায়েরা অতিরিক্ত কঠোর ছিলেন, তাদের মধ্যে অল্প বয়সে মা হওয়ার প্রবণতা শতকরা ৪ ভাগ কম। শক্ত ও রাগী মায়েদের সন্তানরা দ্রুত গ্র্যাজুয়েট হতে পেরেছে এবং ভালো চাকরিও পেয়েছে। এটা শুনতে অবিশ্বাস্য ও হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু শৈশব থেকে কঠোরতায় বড় হওয়া সন্তানরা সফলতায় এগিয়ে। তবে তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যস্ততা, অসহিষ্ণুতা, দায়িত্বহীনতা এবং স্নেহহীনতার এই যুগে কর্মজীবী মেয়েদের জন্য সব থেকে অসহায়ত্ব নেমে আসে তাদের সন্তান ধারণ, বহন এবং লালনপালনের ক্ষেত্রে। পরিবারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কর্মজীবী উচ্চশিক্ষিত মেয়েরা তাই মা হতে গিয়ে হয়ে পড়ছেন বিপদগ্রস্ত। এসব অসহায়ত্ব কাটিয়ে যারা মা হতে পারছেন, তাদের কেউ কেউ অনলাইনভিত্তিক সমাজ মাধ্যমে অনেকটা সময় নষ্ট করেন। ফলে সন্তান বড় হয় অনেকটাই মা-বাবার আদর-স্নেহ ছাড়া। আচার-আচরণে দেখা দেয় অস্বাভাবিকতা।
পৃথিবীতে মায়ের ভালোবাসার সঙ্গে আর কিছুই তুলনা করা যায় না, কারণ এটি ভালোবাসার সবচেয়ে বিশুদ্ধ রূপ। তাই সন্তানকে শাসন ও স্নেহ দিয়ে গড়তে হবে। যদিও বর্তমান সময়ে শিশুদের শাসন করা প্রতিটি মা-বাবার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তাদের তিরস্কার করে বা কঠোর শাস্তি দিয়ে শাসন করতে হবে। সঠিক উপায়ে শৃঙ্খলা শেখানোর মাধ্যমে শিশুরা কেবল দায়িত্বশীল হয় না, বরং তাদের আত্মবিশ্বাসও বৃদ্ধি পায়। তাই সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, কোনো সন্তানই যেন তার মা-বাবার আদর-স্নেহ, শাসন ও অনুপ্রেরণা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। অবশ্য সন্তানের মানসিক ভাব বুঝে রাগ ও শাসন এবং অনুশোচনা ও অনুপ্রেরণা প্রয়োগ করার কৌশলে মাকে হতে হবে সন্তানের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক। মা ও সন্তানের ভালোবাসায় সমৃদ্ধ হোক আগামী পৃথিবী। এটাই হোক বিশ্ব মা দিবসের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়