সরকার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়তি গ্যাস সরবরাহের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে শিল্প খাতে এর প্রভাব পড়েনি। ঘোষণার ১৩ দিন পেরিয়ে গেলেও তৈরি পোশাকসহ শিল্প-কারখানাগুলোতে গ্যাসের সংকট একই রকম রয়ে গেছে। প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ কম, আবার যেটুকু গ্যাস মিলছে সেটির চাপও এতটাই কম যে অনেক কারখানায় উৎপাদন কার্যত থেমে গেছে।
বস্ত্র ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, গ্যাসের সংকটের কারণে উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
আর এর প্রভাবে রপ্তানি আয় কমছে, বিনিয়োগ থমকে গেছে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।
সরকারি ঘোষণা, বাস্তবে সংকট
শিল্প খাতে গ্যাসের সংকট কাটাতে গত ৭ মে সরকার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়তি গ্যাস সরবরাহের ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট বিদ্যুৎ খাত থেকে সরিয়ে এবং বাকি ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট অতিরিক্ত এলএনজি আমদানির মাধ্যমে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস সরবরাহের তথ্য বলছে, গত সোমবার দেশে মোট গ্যাস সরবরাহ করা হয় দুই হাজার ৭০১ মিলিয়ন ঘনফুট।
এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ করা হয় এক হাজার ১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, সার কারখানায় সরবরাহ করা হয় ১২৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং শিল্প, আবাসিক ও সিএনজি স্টেশনে সরবরাহ করা হয় এক হাজার ৫৪৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। গত ৬ মে দেশে মোট গ্যাস সরবরাহ ছিল দুই হাজার ৭২৩ মিলিয়ন ঘনফুট। বিদ্যুতে সরবরাহ করা হয় এক হাজার ৬৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, সার কারখানায় সরবরাহ করা হয় ১২৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং শিল্প, আবাসিক ও সিএনজি স্টেশনে দেওয়া হয় এক হাজার ৪৮৯ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত শিল্প-কারখানায় প্রায় ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ বেড়েছে।
তবে এই বাড়তি গ্যাস সরবরাহে শিল্পে তেমন একটা প্রভাব পড়েনি বলে জানিয়েছেন শিল্পের উদ্যোক্তারা।
পেট্রোবাংলা ও তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমানো হলে ব্যাপক লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে জুনের আগে শিল্পে উল্লেখযোগ্য হারে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর সম্ভাবনা কম।
শিল্প মালিকদের ক্ষোভ
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছিল, দ্রুত সময়ের মধ্যে শিল্পে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হবে। আর বাকি ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট দেওয়া হবে এলএনজি কার্গো এলে।
কিন্তু এখন পেট্রোবাংলা বলছে, আপাতত ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট দেওয়া হবে, বাকিটা এলএনজি এলে। বাস্তবে এখনো শিল্প খাতে গ্যাসের সরবরাহ তেমন বাড়েনি। সরকার শুধু আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছে।’
আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ আরও বলেন, ‘এর মধ্যে গ্যাসের দাম বেড়েছে, ব্যাংকঋণের সুদ বেড়েছে, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়ছে, অথচ উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এই অবস্থায় শিল্প কিভাবে টিকে থাকবে? সক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে এত খরচ সামলানো সম্ভব নয়। এভাবে চলতে থাকলে কারখানাগুলো দেউলিয়া হয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। আমরা বারবার বললেও কোনো কার্যকর সমাধান পাচ্ছি না।’
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি বলেন, ‘শুধু আশ্বাসে শিল্প চলে না। এখন পর্যন্ত গ্যাসের চাপ আগের মতোই। উৎপাদন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ সক্ষমতায় চললে শিল্প টিকবে কিভাবে?’
এ বিষয়ে বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়লেও সরবরাহ বাড়েনি। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের কথা বলা হলেও দেশীয় বিনিয়োগকারীরা দেউলিয়া হওয়ার পথে।’
সাভার-আশুলিয়ায় ভয়াবহ অবস্থা
গ্যাসের সংকটের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে সাভার ও আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলে। সেখানে কারখানাগুলো দিনে মাত্র ১ থেকে ২ পিএসআই গ্যাস পাচ্ছে, যেখানে প্রয়োজন ১০ থেকে ১৫ পিএসআই।
জেকে গ্রুপের এইচআর ম্যানেজার মো. মাহাবুব বলেন, ‘গ্যাস না থাকায় ডিজেল দিয়ে বিকল্পভাবে উৎপাদন চালাতে হচ্ছে। তাতে খরচ দ্বিগুণ হলেও বায়ার পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে না। ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে।’
রাইজিং গ্রুপের ম্যানেজার তৌহিদ খান বলেন, ‘দিনে গ্যাস নেই বললেই চলে। রাতের অল্প গ্যাসে শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরি দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে। তাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ।’
উইন্টার ড্রেস লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পোশাক খাত হুমকির মুখে পড়েছে। অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’
সংকট না কাটলে কী হবে?
শিল্প উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, দ্রুত গ্যাস সরবরাহ না বাড়ালে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও রপ্তানি আয় আরও কমবে। তাতে ডলার সংকট আরও তীব্র হবে, যার প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
সরকারের পক্ষ থেকে একের পর এক ঘোষণা এলেও বাস্তবায়নে গতি নেই—এমন অভিযোগ করছেন প্রায় সব শিল্প মালিক। তাঁরা বলছেন, শিল্প খাত বাঁচাতে হলে এখনই কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সূত্র: কালের কণ্ঠ