সকালে সূর্য উঠেছে সেই কখন, তবু কালু কাঁকড়ার চোখে তখনো ঘুম। মটকা মেরে পড়ে রয়েছে গর্তের ভিতরে।
সে থাকে পানির নোনা ধারার কাছেই, এক নুড়ির মাঝে লুকানো তার ছোট্ট সেই গর্তে।
কিন্তু প্রতিদিন ঠিক একই সময়ে ‘ঝপঝপ ঝপঝপ’ শব্দ তুলে ছুটে আসে একটা ঢেউ। নাম তার ঝপাঝপ-সমুদ্রের সবচেয়ে চঞ্চল ঢেউটা।
‘ওঠো, ওঠো কালু ভাই, সকাল হলো, হাওয়ার ছোটাছুটি শুরু হয়েছে! আর তুমি সেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রয়েছ!’
ঝপাঝপ এসব বলে, আর ঝাঁপিয়ে পড়ে কালুর গর্তের ধারে।
পানি ছিটকে পড়ে চারপাশে, আর তখন কালুর ঘুম ভেঙে যায়।
‘উফ! আবার তুমি? একটু ঘুমোতে দাও না বাপু! আমি তোমার কী ক্ষতি করেছি বলতে পারো? এভাবে কেন রোজ আমার ওপর তুমি পড়ে রয়েছ?’
কালু গজগজ করে, একটু চোখ মেলে, তারপর আবার ঢুকে পড়ে গর্তে। ঘুমোতে হবে আরও। এখনো ঘুম পূর্ণ হয়নি তার।
ঝপাঝপ রাগ করে না। হেসে বলে, ‘তুমি তো চিরকালই ঘুমকাতুরে! আমি তো শুধু বন্ধুদের জাগাতে এসেছি! তুমি কিন্তু একটু বেশিই রাগ দেখাচ্ছ! তুমি উঠলে ওঠো, না উঠলে নাই।’
এভাবেই চলতে থাকে দিন, মাস, অনেকটা সময়। কালু বিরক্ত হয়, কিন্তু ঝপাঝপ তার উল্টো। চরম উৎসাহী।
এর মাঝে ঝিনুক ভাই গুনগুন করে গান গায়।
নুড়ি খুকি শান্ত গলায় বলে, ‘তোমরা ঝপাঝপের কথা একটু ভাবো... সে খারাপ তো কিছু বলছে না!’
একদিন সকালে কী কারণে যেন ঝপাঝপ সমুদ্রতীর কাঁপিয়ে এলো না।
তবে সেদিন কালু উঠে পড়ে আপনা-আপনিই। কেউ তাকে আজ ঘুম থেকে উঠতে তাড়া দেয়নি। কালু ভাবল-
‘কী ব্যাপার! এতটা শান্ত কেন আজ?
সমুদ্র যেন ঘুমিয়ে গেছে! ঢেউ নেই, সব স্তব্ধ!’
বিষয়টা নিয়ে সবাই কৌতূহলী-ঝিনুক ভাই, নুড়ি খুকি, এমনকি কালুও।
‘ঝপাঝপ কোথায়? ওর কিছু কি হয়েছে?’
কালুর বুকটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে। ওর কিছু হয়নি তো!
ঝপাঝপ তো ছিল, আমাদের কাছেই, ও তো রোজ সকালে তাকে ঘুম ভাঙাত।
বিরক্ত লাগত ঠিকই, তবু সেই বিরক্তির ভিতরই ছিল এক নতুন সকালের আবির্ভাব।
ওদের ভাবনা বাড়ে। কিন্তু সমাধান পায় না।
বিকালের দিকে হঠাৎ ফিরে আসে ঝপাঝপ। তারপর হাসতে হাসতে বলে, ‘দুঃখিত কালু ভাই, আজ একটু মন খারাপ ছিল... তাই আসিনি। নিশ্চয়ই তোমরা আজ আনন্দে ছিলে। কেউ তোমাদের কানের কাছে এসে আমার মতো বকবক করেনি!’
কালু ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ঝপাঝপের দিকে, বলে, ‘সত্যি বলতে কী, আমারও মন খারাপ ছিল, আজ তোমাকে না পেয়ে। তুমি হলে আমার ঘড়ির মতো, রোজ আমাকে জাগাও, তবু আমি তোমাকে রাগ করে যা-তা বলি-এটা একদম ঠিক না! আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।’
কালুর আন্তরিক কথায় ঝপাঝপের চোখ চিকচিক করে ওঠে।
সে বলে, ‘তুমি কি তাহলে এখন বুঝেছো?’
কালু হেসে মাথা নাড়ে।
ঝিনুক ভাই তখন এই খুশিতে গলা খুলে গান গাইতে থাকে আর নুড়ি খুকি বলে, ‘এটাই তো বন্ধুত্ব!’
এর পর থেকে কালু আর কখনো ঝপাঝপের ওপর রাগ করে না।
ঝপাঝপ এলে সে হেসে বলে, ‘শুভ সকাল, বন্ধু!’
আর গর্ত থেকে সে নিজেই বেরিয়ে আসে।
এর পর থেকে তাদের ছোট্ট উপকূলে, সমুদ্রের ধারে, ভোর হয়-আর সেটা স্নিগ্ধ, শান্ত আর বন্ধুত্বে ভরা।