আগে রাখাইনে জান্তা বাহিনীর নির্যাতনের কথা শোনা গেলেও এখন আরাকান আর্মির নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে নতুনভাবে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের দাবি, জান্তা বাহিনীর চেয়ে বেশি নির্যাতন চালাচ্ছে আরাকান আর্মি। প্রায় প্রতিদিন নানা কৌশলে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছেন। এ অবস্থায় ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকার জায়গা সংকট দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে নতুন করে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন।
এদিকে সংকটের এমন প্রেক্ষাপটে আগামীকাল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ওইদিন বিকাল সাড়ে ৩টায় তিনি উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। উখিয়ার ১১ নম্বর ক্যাম্প আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা রহিমা (২১) বলেন, ‘আরাকান আর্মির জুলুম বেড়ে গেছে। জুলুম সহ্য করতে না পেরে বাংলাদেশে চলে এসেছি। মিয়ানমারের পেরাংপুর থেকে নৌকায় উঠে নাফ নদ পাড় হয়ে টেকনাফে জাদিমুরা দিয়ে বাংলাদেশে এসেছি।’ মিয়ানমারের মংডু কিংবা বুচিদং থেকে অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে। কেউ এসেছেন এক মাস আগে আবার কেউ এসেছেন এক সপ্তাহ কিংবা কয়েক দিন আগে। অনুপ্রবেশ করা আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, রোহিঙ্গা তরুণ-তরুণীদের জিম্মি করছে আরাকান আর্মি। পুড়িয়ে দিচ্ছে বসতি আর অভিযানের নামে ধরে নিয়ে ব্যবহার করছে তাদের নানা কাজে। নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, রাখাইনে আরাকান আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মধ্যে সংঘর্ষ, সংঘাত ও সহিংসতার কারণে অনুপ্রবেশ বেড়েছে। গত কয়েক মাসে সেখানে খাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যে বুচিদং গ্রামে রোহিঙ্গা যুবকদের জোরপূর্বক তাদের দলে যোগ দিতে বাধ্য করছে আরাকান আর্মি। আবার রোহিঙ্গাদের হত্যা, গুম, নির্যাতন, বিদ্রোহীদের মানবঢাল ও শ্রমিক হিসেবে ব্যবহারসহ নানা ধরনের নির্যাতন করা হচ্ছে।
এসবের কারণে অনুপ্রবেশ থামছে না। রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর পর এবার আরাকান আর্মিও রাখাইনকে রোহিঙ্গাশূন্য করার মিশনে নেমেছে।
টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির সংলগ্ন কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে রাতে উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। সেখানেও বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।’
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের জানান, ‘রাখাইনে ১৭টি শহরের মধ্যে ১৪টি এখন আরাকান আর্মির দখলে। তাদের হাতে রয়েছে দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আর রাখাইনে বাকি শহরগুলোতে জান্তা বাহিনীর হাতে রয়েছে আরও ২ লাখ রোহিঙ্গা। তবে জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে তাড়িতে দিতে এখন দায়িত্ব দিয়েছে আরাকান আর্মির হাতে। জান্তা বাহিনী যেভাবে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে তাড়িয়ে দিয়েছে সেই একই রকমভাবে নির্যাতন করছে যাতে বাকি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে বা বিদেশে পালিয়ে যায়। তারা মূলত রাখাইনকে রোহিঙ্গা ও মুসলিমশূন্য বানাতে চাচ্ছে।’
মোহাম্মদ জোবায়ের আরও বলেন, ‘খেত-খামারে যেতে চাইলে ২ হাজার টাকা, বাজারে যেতে ৫ হাজার টাকা ও এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে ১০ হাজার টাকা দিতে হয় আরাকান আর্মিকে। আর সময়ে সময়ে গ্রামের মধ্যে খারাপ লোক ঢুকেছে বলে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে, তারপর ঘর-বাড়ি থেকে মালামাল লুট করে রোহিঙ্গা যুবকদের ধরে নিয়ে যায় আর রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করছে। রোহিঙ্গা যুবকদের অনেককে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। আবার অনেককে জেলখানায় ঢুকিয়ে রাখছে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে আসছে। প্রতিদিনই টাকার বিনিময়ে ৫০ জন কিংবা তার চেয়েও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসছে।’
এদিকে নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে বসবাসের জন্য বসতি বরাদ্দ দিতে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন। এমন তথ্য জানিয়ে ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা ওদেরকে বলেছি এখানে কোনো জায়গা নেই। আপাতত কমিউনাল সেন্টারগুলো সংস্কার করার জন্য বলা হয়েছে। এই সেন্টারগুলো তারা মেরামত করে সেখানে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের রাখার প্রাথমিকভাবে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পয়লা মে পর্যন্ত নতুন আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার। আর গত এক সপ্তাহের মধ্যে আনুমানিক ৩ হাজারের বেশি নতুন রোহিঙ্গা এসেছে, যার তথ্য এখনো হালনাগাদ করা হয়নি।
সরকারের হিসাবে, দেশে ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের বেশির ভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারে সহিংসতার সময় পালিয়ে আসে। এর মধ্যেই নতুন করে আরও ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।