নগরায়নের অতি প্রবাহে মৌলভীবাজারের প্রকৃতি যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। জল, মাটি ও বাতাস দূষণে প্রতিনিয়ত ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। একসময় নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জেলা এখন দখল–দূষণে বিপর্যস্ত। তারই সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া মনু নদী।
দীর্ঘদিন ধরে ভরাট, দখল এবং বর্জ্য ফেলার কারণে নদীটি হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক প্রবাহ ও সৌন্দর্য। কোথাও গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা, কোথাও আবার নদীর বুকজুড়ে জমে আছে আবর্জনার স্তূপ। ফলস্বরূপ নদী আজ মৃতপ্রায়, আর মৌলভীবাজারের পরিবেশও চরম সংকটে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীর দুই তীরজুড়ে চলছে দখল ও দূষণের মহোৎসব। চাঁদনীঘাট, সৈয়ারপুর, পশ্চিমবাজার ও বড়হাট এলাকায় অবাধে স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপলাইনও সংযুক্ত করা হয়েছে নদীর স্রোতে। ফলে শহরের ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য প্রতিনিয়ত মনু নদীতে গিয়ে পড়ছে।
চাঁদনীঘাট এলাকার মনু সেতু থেকে পূর্ব দিকে গেলে দেখা যায়, নদীর দক্ষিণ তীরে স্থায়ী বাজার ও বসতি গড়ে উঠেছে। বাজারের ব্যবসায়ীরা মাছ, কাঁচা তরকারিসহ নানা পণ্য বিক্রি করছেন নদীর পাড়ে। কিন্তু প্রতিদিনই বিক্রিত পণ্যের বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। তীব্র দুর্গন্ধে আশপাশের পরিবেশ অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা রাকিব বলেন, “অবিক্রিত শাকসবজি, পচা মাছ, পলিথিন—সবই নদীতে ফেলা হয়। এতে নদী দূষিত হচ্ছে, দুর্গন্ধে থাকা দায় হয়ে পড়েছে।”
সৈয়ারপুর এলাকার মো. আমিতাব বলেন, “নদীর পাড়ে অনেক বাসা আছে, সেগুলোর ময়লা পলিথিনে ভরে নদীতে ফেলা হয়। এখন নদীর পানি কালচে, গন্ধে শ্বাস নেওয়া কষ্টকর।”
অন্যদিকে স্থানীয় বাসিন্দা মামুনুর জানান, “নদীর পাশে থাকা বেশিরভাগ বাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপলাইন সরাসরি নদীর সঙ্গে যুক্ত। ফলে নদী দূষণের মাত্রা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।”
পরিবেশবিদদের মতে, নদী শুধু জলধারা নয়, এটি একটি জীবন্ত প্রতিবেশব্যবস্থা। মনু নদীতে বর্জ্য ফেলার ফলে নদীর জলজ প্রাণী, তীরবর্তী ফসল এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী সবাই হুমকির মুখে পড়ছে।
খসরু, স্থানীয় এক পরিবেশকর্মী বলেন, “আমাদের ঐতিহ্যবাহী নদীগুলো রক্ষায় সবাইকে সচেতন হতে হবে। নদী বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, আর প্রকৃতি বাঁচলে আমরা বাঁচব।”
বাপা মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়ক আ স ম সালেহ সোহেল বলেন, “নদের অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে। বর্জ্যে ভরে গেছে নদীর বুক। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে না আনলে মৌলভীবাজার শহরের পরিবেশ একদিন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই পদক্ষেপ নিতে না পারলে মৌলভীবাজারের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংসের পথে যাবে। নদীপাড়ের বাজার ও অবৈধ স্থাপনা অপসারণ, ময়লা ফেলা বন্ধ এবং পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপলাইন বিচ্ছিন্ন করা জরুরি। তাহলেই হয়তো বাঁচানো যাবে মনু নদীকে—ফিরবে মৌলভীবাজারের হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্য ও পরিবেশের ভারসাম্য।
বিডি প্রতিদিন/আশিক