বৈচিত্র্যময় প্রাণীজগতে ভরা আমাদের এই পৃথিবী। বাংলাদেশেও বিচিত্র আর নানা রঙ-বেরঙ, নানা প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। তবে এর মধ্যে সুন্দর কিন্তু নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে এখনও টিকে থাকার যুদ্ধে এমনই অদ্ভুত এক প্রাণীর নাম চশমাপরা হনুমান (Phayre’s Langur)। দিনদিন অন্য সব প্রাণীর মতো বিপন্ন হচ্ছে সুন্দর এই প্রাণীটি। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী ‘বিপন্ন’ আর বাংলাদেশে ‘মহাবিপন্ন’ চশমাপরা হনুমান।

এর মতো আরো একটি প্রাণী বিলুপ্তির সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সেটি হলো উল্লুক (Western Hoolock Gibbon)। মানুষের মতো পরিবার প্রথায় অভ্যস্ত এই প্রাণীটি বিশ্বজুড়েই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রাণীদের লাল তালিকায়ও রয়েছে এই প্রাণীটি।

বিলুপ্তির সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা বানরগোত্রীয় প্রাণীর (প্রাইমেট) একটি বৈশ্বিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এ দুটি প্রাণী। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন ‘প্রাইমেটস ইন পেরিল: দ্য ওয়ার্ল্ডস টুয়েন্টিফাইভ মোস্ট এনডেঞ্জারড প্রাইমেটস’ (২০২৩-২৫) শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য এসেছে।
বিশ্বের প্রখ্যাত সংরক্ষণ সংগঠন IUCN SSC Primate Specialist Group, Re:wild এবং International Primatological Society (IPS) যৌথভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বন ধ্বংস, শিকার, পাচার ও সড়ক দুর্ঘটনার কারণে এই দুটি প্রজাতি এখন বিলুপ্তির পথে।
২০২৫ সালে জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের কয়েকটি বনাঞ্চলে মাত্র ৪৮৪টি চশমাপরা হনুমান টিকে আছে। হবিগঞ্জের সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা এবং মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া, আদমপুর, পাথারিয়া ও সাগরনাল বনে এদের অস্তিত্ব রয়েছে। চশমাপরা হনুমান দুই দশক ধরে IUCN-এর লাল তালিকায় ‘বিপন্ন’ শ্রেণিতে অবস্থান করছে।

অন্যদিকে, উল্লুক বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সীমান্তবর্তী চিরসবুজ বনে বসবাস করে। ২০০৮ সালেও ‘প্রাইমেটস ইন পেরিল’ তালিকার শীর্ষ ২৫-এ ছিল এই প্রজাতি। ২০২০ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৮০ সালে দেশে উল্লুকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ হাজার, যা কমে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৪শ’-তে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া বসবাসের উপযোগী বনভূমি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৯৪ বর্গকিলোমিটার।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন প্রজন্মে এই প্রজাতি দুটির সংখ্যা ৫০–৮০% হ্রাস পেয়েছে। তাদের বিলুপ্তির পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে— বন উজাড় ও আবাসস্থল ধ্বংস, শিকার ও পাচার, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু এবং সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি।
বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানান, উল্লুক সংরক্ষণে একটি খসড়া কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত আছে এবং শিগগিরই এটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। চশমাপরা হনুমান নিয়েও একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে লাউয়াছড়া বনে একটি রোপওয়ে তৈরি করা হয়েছে, যাতে উল্লুক নিরাপদে এক বন থেকে আরেক বনে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রাণী গাছনির্ভর, তাই বন উজাড় বন্ধ না হলে তাদের টিকে থাকা অসম্ভব। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার মিলে এই প্রজাতিগুলো রক্ষায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এ ছাড়া গবেষণায় অর্থায়ন, বন সংরক্ষণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এই প্রাণীগুলোকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই দুটি প্রজাতি অদূর ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল