এক যুগের বেশি সময় আগে ২০১২ সালে নির্মাণ পরিকল্পনা করা হলেও আজও শেষ হয়নি বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ। এত দিন থেমে থেমে কাজ চললেও গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে নির্মাণকাজ। তবে এ প্রকল্পের আওতাধীন বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরমুখী সড়কে নির্মিত কয়েকটি ওভারপাস দিয়ে যানচলাচল করছে। যদি এসব ওভারপাস (লেন) দিয়ে বিশেষায়িত বাস চলার কথা। কিন্তু প্রকল্প নির্মাণ শেষ করতে না পারায় এই লেনে চলার জন্য বাসও ক্রয় করা সম্ভব হয়নি। এদিকে এই মুুহূর্তে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই প্রকল্পের কাজ পুনরায় শুরু করাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য আপাতত কাজ বন্ধই থাকছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার এ প্রকল্পটি দ্রুত সমাপ্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব একনেক উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উপস্থাপন করা হলেও তা আর অনুমোদন পায়নি।
জানা যায়, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটারের বেশি সড়কপথে বাসের জন্য বিশেষ লেন নির্মাণ বা বিআরটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১২ সালে। যা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। তবে মাঠপর্যায়ে সেই নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এরপরও এ প্রকল্পের নির্মাণকাজের ধীরগতি পিছু ছাড়েনি। একাধিক দুর্ঘটনার কারণে বারবার কাজ পিছিয়েছে। ব্যয় সংশোধনও করা হয়েছে তিনবার। ২০২৫ এর জুনে প্রকল্পটি পুরোদমে চালুর কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। এতে করে বন্ধ হয়ে যায় প্রকল্পের কাজ। তবে ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রকল্পটি চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল। সাবেক সরকারের ডিজেলচালিত এসি বাসের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎচালিত বাস কেনার সিদ্ধান্তও হয়। সে অনুসারে, ১৩৭টি ডিজেলচালিত এসি বাস ও ৫০টি বিদ্যুৎচালিত বাস কেনার প্রস্তাব করা হয়। যেসব বাসের সঙ্গে থাকবে ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম বা আইটিএস। এর মাধ্যমে বাসের ভিতর স্বয়ংক্রিয় ভাড়া পরিশোধ ব্যবস্থা, এক বাসের সঙ্গে অন্য বাসের ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। এ ছাড়া থাকবে বাসের অবস্থান শনাক্ত করার ‘রিয়েল টাইম’ ব্যবস্থা। এ ছাড়া বিদ্যুৎচালিত বাসের জন্য চার্জিং স্টেশনও বসানো এবং ফাইবার অপটিক লাইন বসানোর জন্যও ব্যয় যুক্ত হয়। কিন্তু চতুর্থবারের মতো ব্যয় সংশোধনের প্রস্তাবে নানা অসঙ্গতির কারণে ফেরত পাঠায় সরকার। ফলে এ প্রকল্পের নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়। জানা যায়, চতুর্থ দফায় সংশোধিত ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। শুরুতে যা ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় বাড়ছে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ প্রস্তাব অধিক যাচাইবাছাইয়ের জন্য ফেরত পাঠানো হয়।
এ প্রসঙ্গে ২৭ জুলাই একনেক সভা শেষে অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, এটি দানবীয় ও অপরিকল্পিত প্রকল্প। এ ধরনের অপরিকল্পিত ও দানবীয় মেগা প্রকল্পে ভুল নকশা চিন্তারও বাইরে। এ ধরনের প্রকল্প কীভাবে নকশা করা হয়েছে, কারা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে- এগুলো আমরা তদন্ত করে দেখবো। এজন্য প্রস্তাবটি ফেরত পাঠানো হয়েছে। অধিক যাচাইবাছাই করে তারপর আমরা এ প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই এ প্রকল্প রয়েছে। সেগুলো বেশ সফল ও সাশ্রয়ী। কিন্তু আমাদের এখানে অভিজ্ঞতার অভাবে সেটার চরিত্রই বদলে ফেলা হয়েছে। এতে করে প্রকল্প এখন জটিল আকার ধারণ করেছে। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা এএফডি, গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি নামের একটি সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকার।
সম্প্রতি প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিমানবন্দর, উত্তরা, আবদুল্লাহপুর ও টঙ্গী এলাকায় কয়েকটি স্টেশনের কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অনেক জায়গায় পদচারী সেতুর কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। কোনো কোনো স্টেশনে এস্কেলেটর ও লিফট লাগানো হয়নি। সড়কের মাঝখানে বিআরটির জন্য নির্ধারিত লেন আলাদা করার জন্য কিছু জায়গায় লোহার রেলিং লাগানো হয়েছে। সেসব রেলিংয়ে কোথাও কোথাও মরিচা পড়ে গেছে। এস্কেলেটর বসানোর সিড়ি প্রস্তুত করে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর। এতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্রও। যেসব স্থানে লিফট স্থাপনের কথা সেসব জায়গায় প্রকল্পের বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে। সেগুলোও চুরি হয়ে যাচ্ছে। আবার এই লেনের নির্মাণাধীন বাসস্যান্ড এবং যাত্রী ছাউনিগুলো রাস্তার মাঝের লেনে স্থাপন করা হচ্ছে। এসব বাসস্যান্ড, সিঁড়ি, লিফট ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণকাজও শেষ হয়নি। অন্যদিকে রাস্তার একটি বড় জায়গা বছরের পর বছর অব্যবহৃত থাকার ফলে এই মহাসড়কের লেগে থাকছে যানজট। এ ছাড়া এই সড়কে পথচারী পারাপারের জন্য যেসব ফুটওভার ব্রিজ ছিল সেগুলোর বেশির ভাগই অপসারণ করা হয়েছে। এতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ রাস্তা পারাপার হচ্ছে। ফলে হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা।
জানা গেছে, এই প্রকল্প নেওয়ার সময় এই লেনে চলাচলের জন্য প্রথমে বলা হয়েছিল একসঙ্গে বেশি যাত্রী পরিবহনের জন্য কেনা হবে জোড়া লাগানো (আর্টিকুলেটেড) বাস। এরপর সিদ্ধান্ত হয় বৈদ্যুতিক বাস কেনার। পরে ডিজেলচালিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস কেনার সিদ্ধান্ত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডিজেলচালিত এসি বাসের সঙ্গে কিছু বিদ্যুৎচালিত বাসও কেনা হবে। কিন্তু একনেক সভায় অতিরিক্ত প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় অনুমোদন না পাওয়ায় এখন সে সিদ্ধান্তও ঝুলে গেছে। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা এএফডি, গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি নামের একটি সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকার।