আট অঙ্গীকারনামা আর ৮৪ প্রস্তাবনাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের পাঠানো ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নতুন করে মতামত জানাতে। মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় তারা কেউ কেউ বলছেন, প্রস্তাবিত সনদে অনেক অসামঞ্জস্যতা আছে। আবার কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিতও হয়নি। খসড়া সনদের ১০ প্রস্তাবের ওপর নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো। অন্যদিকে অসন্তোষ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। তবে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলছেন অন্য কথা। তারা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলেও বাস্তবায়ন চেয়েছেন অতিদ্রুত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতারা জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া নিম্নরূপ :
বিএনপি : জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় কিছু বিষয়ে বিএনপি অসামঞ্জস্য দেখছে বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে শিগগিরই মতামত জানানো হবে। গতকাল এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিএনপির এই নীতিনির্ধারক সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত শনিবার আমরা খসড়া হাতে পেয়েছি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই মতামত জানাব। আপাতত মনে হচ্ছে, কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা আছে এবং কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি।
একই বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, জুলাই সনদে ঐক্যের স্বার্থে বিএনপি ছাড় দিয়েছে এবং সহযোগিতা করেছে। এখন বাস্তবায়ন করা সরকারের দায়িত্ব। তিনি আরও বলেন, এই সনদকে সাংবিধানিক রূপ দিতে হলে সংসদে যেতে হবে। কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যারা নানা দাবি তুলছে, তারা আসলে ব্যর্থ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। শনিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বহুলপ্রত্যাশিত জুলাই সনদের খসড়া পাঠিয়েছে। এতে সাংবিধানিক ও আইনি বৈধতা নিশ্চিত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সনদে রয়েছে রাজনৈতিক ঐকমত্যে গৃহীত ৮৪ দফা বিষয় এবং বাস্তবায়নের আটটি অঙ্গীকারনামা। তবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার স্পষ্ট উল্লেখ নেই। কমিশনের মেয়াদ ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক মাস বাড়ানো হয়েছে। সনদ চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও বৈঠক করার কথা রয়েছে এই কমিটির। এনসিপি : জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া তুলে দিলেও তাতে বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির দাবি, সনদের ভিতরে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত থাকায় এটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। গণমাধ্যমে দেওয়া এক বক্তব্যে জুলাই সনদের খসড়া সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট জাবেদ রাসিন বলেছেন, জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া উল্লেখ করা হয়নি। যা আমাদের জন্য হতাশাজনক। নোট অব ডিসেন্টে যেসব প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে, সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে? তা নিয়েও কোনো ব্যাখ্যা নেই। এমনকি উচ্চকক্ষে পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতি চালুর প্রসঙ্গটিও আসেনি।
নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কার প্রসঙ্গে এনসিপির এই নেতা বলেন, এনসিপি সবসময় উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির দাবি করে আসছে। কিন্তু নিম্নকক্ষে পিআর থাকলে জোট সরকার গঠনের ঝুঁকি তৈরি হবে, যা সরকারকে দুর্বল করবে। তাই নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষে পিআর ইস্যুতে সমাধান দরকার। তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদের সাংবিধানিক ও আইনি বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না- এই প্রস্তাবনা ইতিবাচক। কোনো অপশক্তি যেন সনদ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে, এজন্য এমন বিধান প্রয়োজন। তবে সনদের ব্যাখ্যা আপিল বিভাগের কাছে ন্যস্ত রাখতে হবে।
জামায়াত : একটি দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রয়োজন মনে করছে না বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। তিনি বলেন, জুলাই সনদ ঘোষণা যথেষ্ট নয়। এটাকে আইনি ভিত্তি ও কাঠামোতে রূপ দিতে হবে। এটার আইনি ভিত্তি না দিলে উপদেষ্টা ও আপনার (প্রধান উপদেষ্টা) সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। জুলাই সনদ যদি আইনে ভিত্তি না পায়, বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী শক্তি আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ লাভ করবে। এই জামায়াত নেতা বলেন, সরকারকে তার করণীয় ঠিক করতে হবে। জুলাই ঘোষণাপত্র সংশোধন করতে হবে, অপূর্ণতা পূর্ণ করতে হবে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিলে জনগণের আকাক্সক্ষা পূর্ণ হবে।
হামিদুর রহমান আযাদ আরও বলেন, একটি দল খুব জোর করে বলে, আমাদের সংবিধানের আর্টিকেল সেভেনে জনগণ রাষ্ট্রের যে মালিকানা দিয়েছে, সেটার কথা বলে তারা পাশ কাটাতে চায়। তারা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিকে প্রয়োজন মনে করছে না। তারা বলে, জনগণের অভিপ্রায় সব আইনের ঊর্ধ্বে। সেটাই যদি হয়, আমি বলব আপনারা জনগণের অভিপ্রায়ের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এই যে সংস্কারগুলো হয়েছে সেগুলো শুধু আপনাদের বাসায় জেন্টলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট হিসেবে রেখে দিলে জাতির ভবিষ্যৎ কোথায় যাবে? জামায়াতের এই নেতা বলেন, ৯০-এর গণ অভ্যুত্থানের পর যে রূপরেখা তৈরি হয়েছিল, তখন আমাদের সমর্থনে ৯১-তে যারা সরকারে এসেছিলেন, ওনারা সেই রূপরেখা বানচাল করে দিয়েছেন। বাস্তবায়ন করেননি। এখনো একই ষড়যন্ত্র আপনারা করছেন। জেন্টলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট করবেন, আইনি ভিত্তি দেবেন না, এটা হবে না। তাই জনগণকে বোকা বানাবেন না, জনগণ আপনাদের গোপন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে দেবে না। তিনি আরও বলেন, সত্তরের নির্বাচনের যদি আইনি ভিত্তি রচনা হতে পারে, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন যদি অস্থায়ী সরকার আইনি ভিত্তি পায়, ’৭২-এর সংবিধান যদি সত্তরের নির্বাচনের নির্বাচনি সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে পাস হয়, অনুরূপভাবে জিয়াউর রহমান যে সামরিক শাসক থেকে প্রেসিডেন্ট হলেন, যে গণভোটের মাধ্যমে আপনারা সেই বৈধতা দিয়েছিলেন; সেসব তো আইনি ভিত্তি পেয়েছে। তাহলে আপনারা কি আপনার দলের এই ইতিহাসকে অস্বীকার করবেন? তাই সংস্কারকে বৈধতা দিতে হবে। ঐকমত্যের বিষয়গুলো আইন হিসেবে ঘোষণা ও স্বীকৃতি দিতে হবে। তার ভিত্তিতে নির্বাচন হবে। এ ছাড়া ফ্যাসিবাদী আইনের অধীনে বাংলাদেশের জনগণ সেই নির্বাচন মেনে নেবে না।