বঙ্গোপসাগরের মোহনায়, মেঘনাবিধৌত উপদ্বীপ লক্ষ্মীপুর জেলার রয়েছে সোনালি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। জনশ্রুতিমতে জমিদার রাজা লক্ষ্মীনারায়ণের নামে এ জেলার নামকরণ। নারকেল, সয়াবিন, ইলিশ, পান, ধান, মরিচের এ জনপদ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ব্রিটিশ আমলে সংস্কৃতিচর্চা, বিশেষ করে খেলাধুলা ও নাট্যশিল্পে লক্ষ্মীপুরের গৌরব ছিল।
সোনারগাঁয়ের প্রথম স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসন কেন্দ্র এবং প্রধান নৌঘাঁটি ছিল বঙ্গোপসাগর উপকূলের শস্যভান্ডারখ্যাত লক্ষ্মীপুর। ১৮২১ সালে বৃহত্তর কুমিল্লা থেকে স্বতন্ত্র হয়ে এ অঞ্চলের নাম হয় ভুলুয়া, বর্তমান লক্ষ্মীপুর।
খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১ হাজার বছর আগে এ ভূখণ্ডে প্রথম কৃষিজীবী, ব্যবসায়ী ও শিল্পী শ্রেণির অনার্য ‘কিরাত’ নামক জনগোষ্ঠী বসবাস শুরু করে। চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে কিরাতদের হটিয়ে আর্যরা এবং ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩ শতকে ‘ভুলুয়া’ নামে নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন রাঢ় দেশের ক্ষত্রিয় রাজকুমার বিশ্বম্ভর শূর।
১৮২১ সালে ব্রিটিশ সরকার সন্দ্বীপ, মিরসরাইসহ ভুলুয়াকে জেলায় পরিণত করে। ১৮৬৮ সালে অবিভক্ত জেলার নামকরণ হয় নোয়াখালী। ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের আওতায় নোয়াখালী, ফেনী (জুগদিয়া বন্দর), লক্ষ্মীপুর পৃথক তিনটি জেলার মর্যাদা লাভ করে।
বৈষ্ণবভক্ত ভুলুয়ার রাজারা সংস্কৃতি ও বৈষ্ণব সাহিত্য চর্চা করতেন। ষোড়শ শতকে রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্য নিজেই সংস্কৃত ভাষায় একাধিক নাটক রচনা করেন। যেমন ‘বিখ্যাত বিজয়’ ও ‘কূবলয়স্য চরিত্র’। ষোড়শ শতাব্দীর ভুলুয়ার কবি শেখ সুলায়মানের ‘নসিয়তনামা’ কাব্যে ভুলুয়া রাজ্যের চিত্র পাওয়া যায়।
ত্রয়োদশ, চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে গৌড় ও সোনারগাঁর স্বাধীন সুলতানি আমলে এখানে শুরু হয় বাংলা, ফারসি ও আরবি ভাষার ব্যাপক চর্চা। ভুলুয়ার সন্তান সপ্তদশ শতকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আবদুল হাকিমের স্মরণীয় পঙ্ক্তি আজও জনপ্রিয়-
‘যেসবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সেসবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন’ জানি।’
সে আমলে বাংলা ভাষায় লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে রচিত পুথির মধ্যে রয়েছে ‘গুলে বকাওলি’, ইউসুফ জোলেখা, ‘নূরনামা’ প্রভৃতি।
বৃহত্তর নোয়াখালীর লোকসাহিত্য মধ্যযুগ থেকে পরিপুষ্ট হয়ে এসেছে। এসবের মধ্যে আছে চৌধুরীর লড়াই, পালাগান, বিয়ের গান, সারি-জারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, ফকিরালি, বয়াতি গান, ফসল রোপণ, ফসল কাটা এবং নবান্ন সংগীত। ১৯১৮ সালে তৎকালীন অতিরিক্ত মুনসেফ নরেন্দ্র চক্রবর্তীর নেতৃত্বে স্থানীয় আইনজীবী, সরকারি কর্মচারী, জমিদার ও রাজনৈতিক সচেতন মহলের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘লক্ষ্মীপুর ক্লাব’ ছিল শিক্ষিত ভদ্রলোকদের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র। এখানে রবীন্দ্র-নজরুলের কাব্যালোচনা ছাড়াও বছরে একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হতো। ১৯২৩ সালে বর্তমান সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে আইনজীবী সুধীর বাবু প্রতিষ্ঠা করেন একটি নাট্যমঞ্চ। কলকাতা থেকে নর্তকীদের এনে এখানে নৃত্য পরিবেশন করা হতো। মঞ্চস্থ সাপ্তাহিক নাটকের মধ্যে ছিল সিরাজউদ্দৌলা, টিপু সুলতান, আনোয়ার পাশা, কামাল পাশা ইত্যাদি। অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন সুধীর বাবু, গুরুনাথ রক্ষিত, কালীময় ঘোষ, মুকুন্দলাল নাগ, শ্যাম বাবু, হেমন্ত দাস, সুকুমার, ভূপতিভূষণ চক্রবর্তী, সুধাময় ঘোষ, মনোরঞ্জন, দুর্গাদাস, পরেশ চন্দ্র কর, ব্রজেন্দ্র মুহুরী, মফিজ মুখার্জী, আবদুল হাকিম উকিল, কুন্তলকৃষ্ণ মজুমদার, হাফিজ উদ্দিন, সুজা মিয়া প্রমুখ। পেশাদার যাত্রাদল ছিল শাঁখারীপাড়ায়।
সাহিত্যিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬), বৈবাহিক সূত্রে শামসুন নাহার মাহমুদ (১৯০৮-১৯৬৪), অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, কবি শাহাদাত বুলবুল, কথাসাহিত্যিক হোসনে আরা শাহেদ, গবেষক আলী আহমদ (প্রাচীন পুথির পাণ্ডুলিপি সংগ্রহকার হিসেবে ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন), বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাট্যাভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার, ত্রপা মজুমদার, নাট্যশিল্পী দিলারা জামান, সাহিত্যিক-সাংবাদিক কামাল উদ্দিন আহমদ, সিদ্দিক উল্যাহ কবির, কবি-শিশুসাহিত্যিক সৈয়দ আল ফারুক, কবি ও নজরুল গবেষক আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও গবেষক নূরউল করিম খসরু, গোলাম রহমান, কবি-কথাসাহিত্যিক ও গবেষক আজাদ বুলবুল, নাজিম উদ্দিন মাহমুদ (আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষক) প্রমুখ লক্ষ্মীপুরেরই সন্তান।
১৯২৭ সালে টাউন ক্লাব ও আইনজীবী সমিতির যৌথ উদ্যোগে কবি কাজী নজরুল ইসলামের লক্ষ্মীপুর শুভাগমন ঘটে। লক্ষ্মীপুর মডেল হাইস্কুল মাঠে হাজারো দর্শক-শ্রোতাকে কবির গান বিমুগ্ধ করে। কবিকে রুপার থালা ও বাটি উপহার দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে নজরুল ইনস্টিটিউটের আয়োজনে লক্ষ্মীপুরে তিন দিনব্যাপী নজরুল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ (জন্ম ১৯০৮ সালে, পিতা মোহাম্মদ নুরুল্লাহ, স্বামী ডা. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, ফরাশগঞ্জ সদর, লক্ষ্মীপুর) এ দেশের নারী শিক্ষা, নারীজাগরণ ও মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি কলকাতার লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ঢাকা ইডেন কলেজের বাংলার অধ্যাপক ছিলেন। বিএ পাস করার পর বেগম রোকেয়া তাঁর সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। বেগম রোকেয়ার পাশাপাশি শামসুন নাহার মাহমুদ আমৃত্যু নারী শিক্ষার জন্য কাজ করে গেছেন। বেগম রোকেয়ার সঙ্গে নারীমুক্তি আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি (১৯১১) মহিলা শাখার সভানেত্রী এবং ১৯৪৮ সালে নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতির সহসভানেত্রী ছিলেন। নজরুল তাঁর সিন্ধু হিন্দোল কাব্য বাহার-নাহারকে উৎসর্গ করেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে পুণ্যময়ী, বেগম মহল, রোকেয়া জীবনী, আমার দেখা তুরস্ক, নজরুলকে যেমন দেখেছি ইত্যাদি।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও ভাষাতত্ত্ববিদ মুনীর চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালে, গোপাইরবাগ, রামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরে। পিতা আবদুল হালিম চৌধুরী। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সরকারি বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বক্তৃতা দেওয়ায় গ্রেপ্তার হন। বাংলা বর্ণমালা সংস্কার পদক্ষেপ ১৯৬৮ এবং রেডিও ১৯৬২, টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধে ১৯৬৭ সালে প্রতিবাদ করেন। নাটকে বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেন। নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর রচিত নয়টি নাট্যগ্রন্থের মধ্যে কবর (কারাগারে বসে রচিত), রক্তাক্ত প্রান্তর উল্লেখযোগ্য।
লক্ষ্মীপুরের আরেক গর্ব সাহিত্য ব্যক্তিত্ব, ভাষাসৈনিক, প্রখ্যাত সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী (১৯২৮-২০০১)। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক-সম্পাদক। তাঁর রচিত গ্রন্থ শতাধিক। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৩ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। তাঁর লেখনীতে সমকালীন সমাজচিত্র ও মুক্তিকামী মানুষের সুর বিমূর্ত হয়েছে।
জাতীয় পর্যায়ে প্রথিতযশা সেলিনা হোসেন (জন্ম ১৯৪৭) আধুনিক বাংলা সাহিত্যে একজন ধ্রুপদি কথাসাহিত্যিক। তিনি বাংলা একাডেমির প্রাক্তন সভাপতি। ১৯৮০ সালে উপন্যাসের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০০৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। তাঁর লিখিত প্রতিটি বই উচ্চমার্গের সাহিত্যকর্ম হিসেবে সমাদৃত। তিনি বেশ কয়েকটি উপন্যাসে বাংলা লোকপুরাণের উজ্জ্বল চরিত্রগুলো নতুনভাবে তুলে এনেছেন। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে হাঙর নদী গ্রেনেড, যাপিত জীবন, পোকামাকড়ের ঘরবসতি, নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি, কালকেতু ও ফুল্লরা, গায়ত্রী সন্ধ্যা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের উজ্জ্বল নাম রামেন্দু মজুমদার। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের নাটক তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দেন। তাঁর মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা ৩০। লাভ করেছেন একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ। নিজ জেলার সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নয়নে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা স্মরণযোগ্য।
উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, নায়ক মাহফুজ আহমেদ, নাট্যকার-অভিনেতা ও ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাতা বাবুল বিশ্বাস, উপস্থাপক ইব্রাহিম ফাতেমী, পরিচালক ইসমাইল হোসেন ও অরণ্য আনোয়ার, অভিনেত্রী-মডেল তারিন, অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ, মডেল তৃষা, চিত্রনায়িকা দোয়েল, চিত্রনায়ক সুব্রত, মডেল-অভিনেত্রী দীঘি, মডেল-অভিনেত্রী হুমায়রা হিমু, কণ্ঠশিল্পী মাহবুব হোসেন মোহন ও ক্লোজআপ ওয়ান শীর্ষ ১০ তারকার একজন লক্ষ্মীপুরের ইদ্রিছ আনোয়ার পরানের নাম উল্লেখ করতে হয়। যদিও তাঁদের সবাই এখন আর আমাদের মধ্যে নেই।
লক্ষ্মীপুরে ভাসানচন্দ্র দাস ও হিরণ্য কুমারের নেতৃত্বে পঞ্চাশের দশকে সবুজ সংঘ, মফিজ মুখার্জী, হাফিজ উদ্দিন আহমদ প্রমুখের নেতৃত্বে চল্লিশের দশকে ফ্রেন্ডস ড্রামাটিক ক্লাব, ১৯৫৮ সালে লক্ষ্মীপুর টাউন ক্লাব ও পাবলিক লাইব্রেরি সংস্কার কার্যক্রম নতুন সাংস্কৃতিক মাত্রার জন্ম দেয়। ত্রিধারা শিল্প ও সাহিত্য-সংস্কৃতি সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে (চেতনা নামক সাময়িকীসহ) অধ্যাপক ননী গোপাল ঘোষ, ইসমাইল জবি উল্লাহ (প্রাক্তন সচিব), জেড এম ফারুকী, অধ্যাপক মোবাশ্বের আহমেদ, সিদ্দিক উল্লাহ কবির প্রমুখের নেতৃত্বে। ১৯৭৩ সালে ইসমাইল জবি উল্লাহ, অ্যাডভোকেট তারেক চৌধুরী, মোবাশ্বের আহমদ, মোতাহের আহমদ প্রমুখ গঠন করেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ডাক দিয়ে যাই’ (গণমুখ সাময়িকীসহ)।
রামেন্দু মজুমদার, গোলাম রহমান, হিমাদ্রি মুখার্জিসহ কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তির উদ্যোগে (১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত) লক্ষ্মীপুর পাবলিক লাইব্রেরি ও টাউন হল সংস্কার করার জন্য ১৯৫৮ সালে একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন রামেন্দু মুজমদার এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদক গোলাম রহমান।
১৯৭৯ সালে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন চক্রবাক প্রতিষ্ঠা করেন অধ্যাপক খলিলুর রহমান চৌধুরী। ১৯৮৪ সালে জেলা শিল্পকলা একাডেমি গঠিত হলে জাতীয় দিবস পালন উপলক্ষে সংস্কৃতিচর্চা হতো। ১৯৮৫ সালে লক্ষ্মীপুর থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর থেকে লক্ষ্মীপুরের নাট্য-সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণ পায়। লক্ষ্মীপুর থিয়েটার গঠনেও প্রাণ সঞ্চারে শামছুদ্দিন ফরহাদ (নোয়াখালী), শহিদ উল্যা খন্দকার, অধ্যাপক মাইন উদ্দিন পাঠান, অ্যাডভোকেট শৈবাল সাহা, জাকির হোসেন ভূঁঁঞা আজাদ, সেলিম রেজা, মোরশেদ আনোয়ার, দিলীপ চৌধুরী, আবুল হাসেম, মোস্তফা ফারুক বাবুল, আমির হোসেন, মরহুম আলাউদ্দিন, আবুল কালাম আযাদ, জিয়াউর রহমান, মানজুমান আরা, ইসরাত জাহান ইয়াসমিন, নুরনবী কবির, অহিদুর রহমান প্রমুখ ভূমিকা রাখেন।
একই সময়ে সদর ইউএনও জাফর আহমদ চৌধুরী, গণপূর্তের ইঞ্জিনিয়ার জিয়াউদ্দিন আহমেদের পৃষ্ঠপোষকতায় লক্ষ্মীপুর সাহিত্য সংসদ গঠন করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন দিলীপ চৌধুরী, মাইন উদ্দিন পাঠান, সেলিম রেজা, মাহবুবুল বাসার প্রমুখ। এ সংগঠন থেকে নিয়মিত ‘প্রচ্ছদ’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ হতো। ১৯৮৭ সালে রেজাউল হাকিম ও মোরশেদ চৌধুরীর সহযোগিতায় মাহবুবুল বাসারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা লাভ করে অনুরাগ শিল্পীগোষ্ঠী। ১৯৯৩-এ বেলায়েত হোসেন রিপনের উদ্যোগে হাইফাই কৌতুক শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং যদুগোপাল দাস প্রতিষ্ঠা করেন জেলা সংগীত একাডেমি। এ ছাড়া ১৯৯৪-এ জেলা শিশু একাডেমি লক্ষ্মীপুর স্থাপিত হয়।
স্থানীয় কবি-লেখকের লেখালেখির সুযোগ করে দিয়েছিল যে কটি পত্রিকা ও সাময়িকী, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সাংবাদিক এম এ মঈদ সম্পাদিত সমবায় বার্তা, অধ্যাপক আবদুল হাই সম্পাদিত সাপ্তাহিক নতুন সমাজ, গোলাম রহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক দামামা, মাইন উদ্দিন পাঠান সম্পাদিত আনন্দ আকাশ, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া সম্পাদিত সাপ্তাহিক এলান ও দৈনিক ভোরের মালঞ্চ, এম হেলাল সম্পাদিত লক্ষ্মীপুর বার্তা এবং হোসাইন আহমদ হেলাল সম্পাদিত সাপ্তাহিক নতুন পথ, এই প্রবন্ধকার সম্পাদিত মাসিক বাংলা আওয়াজ ও বিচিত্রতা, মুস্তাফিজুর রহমান সম্পাদিত নয়া ইসক্রা ও এস এম জাহাঙ্গীর সম্পাদিত খুঁটি।
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে আশির দশকে বাংলা বিভাগের প্রভাষক আনিসুল হকের নেতৃত্বে সাহিত্যচর্চায় উঠে আসেন কলেজের ছাত্র আবু হেনা আবদুল আউয়াল, মুস্তাফিজুর রহমান, তমিজ চৌধুরী তরী, শ্যামলী আক্তার প্রমুখ।
১৯৮১ সালে এই প্রবন্ধকারসহ মাহবুবুল বাসার ও শাহ ফারুকের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় লক্ষ্মীপুর মুক্তাঙ্গন গণপাঠাগার। ১৯৯৯ সালে রমেন নাথ, মাহবুবুল বাসার প্রমুখের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় লক্ষ্মীপুর জেলা সাহিত্য সংসদ। এ সংসদ রবীন্দ্র-নজরুল জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন, আবৃত্তি কর্মশালাসহ বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং সাহিত্য-সাময়িকী প্রকাশ করে। এ সংগঠনের বর্তমান সভাপতি কবি-লেখক ডা. মো. সালাহ্উদ্দিন শরীফ।
অধ্যাপক মাইন উদ্দিন পাঠান, কবি আমির হোসেন মোল্যা ও কবি রওশন রুবীর নেতৃত্বে প্রগতি লেখক সংঘ জেলা শাখা সাহিত্য আসরসহ কবিতা সংকলন প্রকাশ করছে। কবি ও আবৃত্তিকার অ্যাডভোকেট মুরাদ-আল-হাসান চৌধুরীর নেতৃত্বে সেঁজুতি ইনস্টিটিউশন আবৃত্তিচর্চা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সাইফুল ইসলাম তপন ও স্বপন দেবনাথের নেতৃত্বে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ লক্ষ্মীপুর জেলা শাখা এবং জাকির হোসেন ভূঁইয়া আজাদ ও মুরাদ-আল-হাসান চৌধুরীর নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। জাতীয় কবিতা পরিষদ লক্ষ্মীপুর জেলা শাখা ২০২৫ সালে নতুনভাবে সংগঠিত হয়।
লক্ষ্মীপুরে বর্তমানে লেখালেখিতে যাঁরা সক্রিয় আছেন তাঁরা হলেন মুস্তাফিজুর রহমান, সালাহ্উদ্দিন শরীফ, মুজতবা আল মামুন, ফকির আশরাফুর রহমান, সায়াদাত উল্যাহ ভূঞা, খাতুনে জান্নাত, আমিনুল ইসলাম মামুন, রীনা তালুকদার, আরাফাত বিন আবু তাহের, সালমা কিবরিয়া, জামিল জাহাঙ্গীর, রওশন রুবী, নাসির উদ্দিন মাহমুদ, ডা. জহির উদ্দিন মাহমুদ, অ্যাডভোকেট বদরউল আলম, ডা. মো. নিজাম উদ্দিন, মিঞা মাহবুব, এস এম জাহাঙ্গীর, মাহবুবুল বাসার, মুরাদ-আল-হাসান চৌধুরী, আমির হোসেন মোল্যা, অলোক কুমার কর, ভিপি বেলায়েত, শাহরিয়ার শাহাদাত, কার্তিক সেনগুপ্ত, ইকবাল হোসেন বকুল, ডা. এম এ এইচ আলমগীর, বাসুদেব পোদ্দার, বাবুল ভৌমিক, অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন রাজু, নাজমুন নাহার সোহাগী (বিশ্ব ভ্রমণকারী পর্যটক), নাজমুন নাহার নাজু, আহসান উল্যা মাস্টার, এম এ রহিম, মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, অ আ আবীর আকাশ, ফারুক হোসেন সিহাব, আবদুর রব ছিদ্দিকী, ম. হোসেন, গাজী নিজাম উদ্দিন, ইউসুফ মাহমুদ সংগ্রাম, কামাল হোসেন টিপু, খালেদা তারেক, হান্নান নীরব, এম জেড মাহমুদ, জাকারিয়া আলমগীর, রাজু হাসান, কাজী ফাহিম, আহমেদ কাওছার বিন জামান, আনিস আহমেদ, হোসেন আহম্মদ জান, নারায়ণ চন্দ্র মজুমদার, অঙ্কুর দেবনাথ, ইকন দাস, শাহাদাত শাহেদ, মাছুম জুলকারনাইন, তকী আকরাম ভূঁইয়া, নাসরীন জাহান রীনা, রুবেল আহমেদ, হোসাইন মো. রাসেল, আপন দে, ফখরুল ইসলাম, কামরুল হাসান হৃদয়, জাহিদ হাসান তুহিন, সোলাইমান চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন রব্বানী, রাজীব হোসেন রাজু, নাসরীন জাহান অনু, মনির হোসাইন সম্রাট, জসীম উদ্দিন মাহমুদ, রায়হানুল ইসলাম পাটওয়ারী, হোসেন শরীফ, শাহরিয়ার মাহমুদ, নুরুল আফছার, শাহাদাত হোসেন নীল, জামাল হোসেন রাজু প্রমুখ কবি ও লেখক। এঁদের অনেকের কাব্যগ্রন্থ, কারও কারও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
সত্যিকার অর্থে অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠলে এবং সাহিত্যের অনুরক্ত শিক্ষিত সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় লক্ষ্মীপুরের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গন আরও সমৃদ্ধ ও বিকশিত হতে পারে। লক্ষ্মীপুরের সাহিত্য-সংস্কৃতি জগৎ আলোকিত হোক।