ভ্রমণ
সকাল ১০টায় হোটেল উইলো ব্যাঙ্কস থেকে মল রোড ধরে ‘বুক ক্যাফের’ দিকে হাঁটা দিলাম। হোটেলের রিসিপশন্স থেকে সোজা ঝাকু মন্দিরের দিকে হাঁটতে বলে দিয়েছিল। বুক ক্যাফেতে ব্রেকফাস্ট করবো বলে সকালের নাশতা ইচ্ছে করেই বাদ দিয়েছিলাম। চলার পথে কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু ঢালু সমতল বরাবর চলে গেছে। ১০ মিনিটের এই চলার পথে দেখছি কত বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র ভাষায় কথা বলছে আর দল বেঁধে একদল নিচের দিকে আর অন্য দল উপরের দিকে যে যার গন্তব্যে হাঁটছে। হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল। শীত আর ঠান্ডা হাওয়ার এক চমকপ্রদ অনুভূতি। রাস্তার দুই ধারে, বিশেষ করে পাহাড়মুখী ঢালে সারি সারি হিমালয়ান ওক, পাইন আর রোডেন্ড্রন গাছ চোখে পড়ার মতো সুন্দর। মাঝে মাঝে গাছের ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা বুকে দারুণভাবে এসে লাগছে।
বুক ক্যাফের অবস্থান নিরিবিলি আর খানিকটা উঁচু বনাঞ্চলে। এই পথে হাঁটলে প্রকৃতির এক নির্জন, নির্মল ও শান্ত পরিবেশের ভেতর দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়। শান্ত প্রকৃতি, পাইন পাতার সুঘ্রাণ আর পাখির ডাক শুনতে শুনতে স্ক্যান্ডাল পয়েন্ট হয়ে ক্যাফেতে এসে উপস্থিত হলাম। বুক ক্যাফে শিমলার টাক্কা বেঞ্চে, দ্য রিজ এলাকার পাশে অবস্থিত একটি অনন্য ক্যাফে, যেখানে সাহিত্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সামাজিক উদ্যোগ একত্রে মিলিত হয়েছে। ক্যাফেতে ঢুকতেই চারপাশটা একটু অন্যরকম, একটু ব্যতিক্রমী মনে হলো। এমন সময় একজন আন্তরিক ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বললো : ‘আপনি কী খাবেন?’ আমি হেসে উত্তর দিলাম : “এক কাপ কফি দাও। আর তোমাদের যেটা স্পেশাল ব্রেকফাস্ট, সেটাই দাও।” সে সঙ্গে সঙ্গেই খাবারের মেন্যু নিয়ে এলো। মেন্যুটা খুলতেই চোখে পড়লো নানা ধরনের কফি, আর তার সঙ্গে ছিলো বিভিন্ন স্ন্যাক্স স্যান্ডউইচ, পিজ্জা, কুকিজ আরো ছিল নানা রকম পানীয়ের সমাহার।
কফি হাতে নিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখি-প্রায় ৩০-৪০ জনের বসার সুব্যবস্থা। সঙ্গে বিনামূল্যে Wi-Fi, ই-বুক পড়ার জন্য Kindle, আর একপাশে সাজানো সাড়ে চারশরও বেশি বই, যেগুলো স্থানীয় বাসিন্দা আর পর্যটকরা দান করেছেন। বেশির ভাগ অতিথিই হয় বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন, নয়তো কেউ চুপচাপ লেখালেখিতে মগ্ন। কেউ কেউ আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে সিমলার পাহাড় আর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য একদৃষ্টে উপভোগ করছেন। চারপাশটা ছিল অবাক করা শান্ত, একেবারে নিরিবিলি। আমার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল যখন জানলাম এখানে যারা সার্ভিস দিচ্ছেন, তাঁরা সবাই সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি।
বুক ক্যাফেটি ভারতের হিমাচল প্রদেশ পর্যটন দপ্তরের অর্থায়নে পরিচালিত। পরিচালক জয় আমাকে জানালো, তাদের এই সেবার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এতে তাদের সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেবার মাধ্যমে সাজার মেয়াদ কমিয়ে, স্বাভাবিক জীবনে ফায়ার। জয় একটু থেমে বলল : ‘আমার মেয়াদ আর বেশি নেই, স্যার, শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে। তারপর মেয়েটার কাছে ফিরে যাবো।’ কৌতূহলী আমি জিজ্ঞেস করলাম : ‘ঘটনাটা কীভাবে ঘটেছিল?’ সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে ধীরে বলল, গলায় ছিল একরাশ চাপা অনুতাপ। ‘নেশার ঘোরে স্ত্রীকে আঘাত করি ও মারা যায়। তারপর এক জেল থেকে আরেক জেলে ঘুরতে ঘুরতে এখন এখানে আছি।’ এই কথা শুনে মুহূর্তেই যেন পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠলো। সে একটু চুপ করে থেকে আবার বলল : ‘এই ক্যাফেটা অনেক কিছু শিখিয়েছে স্যার। অনেক মানুষকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। জীবনকে নতুনভাবে জানতে শিখেছি।’ আমি আবার জানতে চাইলাম : ‘তোমার মেয়ের বয়স এখন কত?’ সে হেসে বলল : ‘ঘটনাটা যখন ঘটেছিল, তখন ওর বয়স ছিল তিন বছর। এখন প্রায় দশের কাছাকাছি।‘ ‘সে কার কাছে থাকে?’ ‘ওর দাদির কাছে মানুষ হচ্ছে।’ তারপর চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল : ‘ভাবলে খারাপ লাগে, স্যার, আমি ওর মায়ের হত্যাকারী। কিন্তু জানেন, তারপরও মেয়েটা আমাকে ভালোবাসে।’ একটা দীর্ঘ নীরবতা নামলো আমাদের মাঝে।
এই ক্যাফে পরিচালনা করেন চারজন কর্মচারী। যাদের সবাই জয়ের মতন যারা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি! যারা শিমলা কাথু জেলের কয়েদি। একটি নামকরা হোটেলের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, যাতে গ্রাহকদের উপযুক্ত সেবা দেওয়া যায়। ভেবেছিলাম, ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু কখন যে সময় গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল, বুঝতেই পারিনি! বুক ক্যাফের নিরিবিলি পরিবেশ, চারপাশের বইয়ের গন্ধ, কফির সুঘ্রাণময় উষ্ণতা, আর মানুষের ভেতরের গল্প, সব মিলে একটা অদ্ভুত টান তৈরি করেছিল। ঝাকু মন্দিরে যাওয়ার ইচ্ছেটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, এমন একটা জায়গায়, যেখানে মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো গল্পেরা বসে থাকে, সেখানে বসে থাকা অনেক বেশি অর্থপূর্ণ।
পাদটীকা : যদিও ‘বুক ক্যাফে’ এক সময় কয়েদিদের দ্বারা পরিচালিত হতো এবং সেই অনন্য উদ্যোগের জন্য তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। এখন এটি আর কয়েদিদের দ্বারা পরিচালিত হয় না। বর্তমানে একটি বেসরকারি উদ্যোক্তার তত্ত্বাবধানে ক্যাফেটি পরিচালিত হচ্ছে। তবুও, তার স্বকীয়তা ও পরিবেশের কারণে এটি এখনো স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় গন্তব্য হিসেবে রয়ে গেছে।