দোয়েলের শিস শুনতে গেলে বেঁচে থাকতে হয়, এই পৃথিবীতেই বাঁচতে হয়। কারণ দোয়েলও এই পৃথিবীর বাসিন্দা। বাঁচতে হয়, সহবাসিন্দার দিকে তাকাতে হয়, তাকে মনে নিতে হয়, তবেই শোনা যায় দোয়েলের শিস, সে খুব ভাগ্যের ব্যাপার। সবার ভাগ্যে তা হয় না, কেননা সবাই দোয়েলের সহবাসিন্দা নন।
আধুনিক কবিতার মৌল সারবত্তা উৎকর্ষ ও পরিধির দিক থেকে বহুধা-জ্ঞাপক ও ঋদ্ধিমান হয়েছে ষাটের দশকে এসে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধারার ও ধাঁচের সাহিত্যিক আন্দোলনের নির্যাসিত প্রবাহমানতায় বাংলা কবিতার মানচিত্র বদলে গেছে অনেকখানি। এই বদলের ধাক্কায় আধুনিক কবিতার অন্তর্লীন মোহিনী-স্পর্শ, এর অভ্যন্তরীণ অন্তর-গূঢ় চেতনা-রসে আপ্লুত হয়েছিলেন বগুড়ার সে সময়ের অনেক স্পর্ধী তুর্কি তরুণ।
ষাটের দশকে সৃষ্টি হওয়া অনেক অনেক দিকপাল যারা সত্যিই বগুড়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন কথাসাহিত্য বা কবিতায়। আমরা তাদের চিনি, জানি। কারও ক্ষেত্রে বৃহৎ পরিসরে, কাউকে বা ক্ষুদ্র আয়তনে। কিন্তু এমনও অভাগা, অচ্ছুত, নিরপেক্ষ, নির্দলীয়, চাপা আর গোপন কবি, লেখকের গুপ্ত হাহাকারে আজও বিজলি-বাতাস ভারী হয়ে আছে। বলি সেই কবি, তার নিজ সময়ে খানিকটা আলোচিত, আলোকিত হলেও আজ সময়ের সর্বনামে ঝুলে আছেন। তিরতির করে কাঁপছে তাঁর নামটি কেবল মৃদুমন্দ দু-একজন রাখাল প্রেমিকের কোষের কমনীয় দ্বারে।
ষাট দশকে যাঁরা আত্মপ্রকাশ করেন তাঁরা হলেন- ফারুক সিদ্দিকী, কাজী রব, বজলুল করিম বাহার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সাহেদুর রহমান, মনোজ দাশগুপ্ত, সাইফুল ইসলাম, সাম হেদায়েতুল্লাহ, রেজাউল করিম চৌধুরী, খন্দকার আব্দুল রহিম হীরু, এম আর আখতার মুকুল। এখানে আরও দুজনের নামোল্লেখ করতে চাই বা করা উচিত, তাঁরা বিভিন্ন জেলার অধিবাসী হলেও তাঁদের সাহিত্যযাত্রা শুরু বগুড়ায়। তাঁরা হলেন- কবি মহাদেব সাহা এবং কবি শাহনূর খান।
ষাট দশকে বগুড়া জেলার লেখক যাঁরা জীবিকাসূত্রে বাইরে অবস্থান করেছেন তাঁদের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আন্ওয়ার আহমদ অন্যতম।
ষাটের দশকে আরও যাঁরা বগুড়ার সাহিত্যভূমিতে পা রেখেছিলেন তাঁরা হলেন- নূর মোহাম্মদ তালুকদার, মুহম্মদ রহমতুল বারী, মোস্তফা নূরউল ইসলাম, মিনতি কুমার রায় প্রমুখ। আবার ষাটের একেবারে শেষ পর্যায়ে আরও দু-একজন লেখকের নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন- আবদুর রফিক খান, আরেকজন লেখক সালেহা চৌধুরী।
অগ্রসরমানতায় যে কোনো নতুন সূত্র তুমুল উৎপাত সৃষ্টি করে। এই বর্ধিত কালের দিকে ছুটে যাওয়া, অবিশ্বাস থেকে ক্রমশ উত্থাপিত বিশ্বাসের দিকে আমাদের সামনে ফুটিয়ে তোলে দারুণ আর দীপ্ত ভোরবেলা। সত্তরের দশক মনে হয় তেমনি নি-িদ্র, দৃঢ় প্রতিজ্ঞাপূর্ণ, আবার ঘটনাচক্রে কখনো হতাশায় হাতরে হাতরে ক্ষয়ে যাওয়া পথ অতিক্রমণের ইতিহাস।
১৯৭৪-এ ‘অনুকাল লেখক গোষ্ঠী’র ছায়াতলে বেশ কিছু তরুণ লেখক একত্রিত হন। সমাজ, প্রেম এবং যুদ্ধ-উত্তর নতুন স্বদেশ চেতনায় তাঁদের লেখালেখি এগোতে থাকে। এই দশকে যাঁরা সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তাঁরা হলেন- মনজু রহমান, রায়হান রহমান, আবদুর রাজ্জাক, শোয়েব শাহরিয়ার, মাহমুদ হাসান, জি এম হারূন, পুটু আখতার, মোস্তফা আলী, আফরোজা জাহান, সুজন হাজারী, মতিয়ার রহমান, সাজাহান সাকিদার, হোমায়রা নাজনীন সোমা, অমিয় সাহা, মীর আবদুর রাজ্জাক, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, ফারুক ফয়সল প্রমুখ।
দেশের উত্তরাঞ্চলের মধ্য গগনের অতি স্নিগ্ধ আর শীতল শরমেভরা অদ্ভুত এক শহর ‘বগুড়া’। আশির মধ্যভাগে এ শহরে একসময় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন একঝাঁক তুর্কি-তরুণ কবি। সময়ের পালাবদলের উচ্ছ্বাস তাদের চোখেও লক্ষ করা গিয়েছিল প্রতিশ্রুতির চন্দ্রিমার স্বপ্ন। সেইকালে তাঁদের চিরসবুজ, দীপ্তপ্রাণ আবির্ভাবে নড়েচড়ে বসেছিল পুরো দেশ। তারা তাদের মেধা, মনন, লেখনী দিয়েই জাবেদা খাতায় নাম তুলিয়েছিলেন, চিহ্নিত হয়েছিলেন স্ব-স্ব কবিতার টোনের টংকারে।
তাঁরা হলেন- শেখ ফিরোজ আহমদ, মাসুদ খান, আশীষ-উর-রহমান শুভ, আজিজার রহমান তাজ, সুকুমার দাস, প্রদীপ মিত্র, পলাশ খন্দকার, ফখরুল আহসান, জয়ন্ত দেব, বিদ্যুৎ সরকার, আবদুল্লাহ ইকবাল, রাহমান ওয়াহিদ, মাহমুদ হোসেন পিন্টু, সাকিব হাসান, পান্না করিম, শের আফগান শেরা, ড্যারিন পারভেজ, গাজী সারোয়ার, খাদিজা এলমিস, আবদুর রউফ খান, খন্দকার বজলুর রহিম, সারোয়ার হোসেন বিকাশ, মনসুর রহমান, আবদুর রশিদ, আবদুর রহিম বগরা, ফেরদৌসুর রহমান রিটা।
গৌরবময় নব্বয়ের দশক কবিতার একটি যুদ্ধক্ষেত্র যা তরুণ টগবগে মন ও মেধায় পূর্বসূরিদের অতিক্রম করার এক তীব্র প্রস্তুতি। আর সেইসব কবিরা যাঁরা অনুভব এবং দৃষ্টির সামনে কলম নামক একটি অস্ত্রের সঞ্চরণে সাদার ভিতর শব্দের রেখাঙ্কন করে তুলেছেন সৃষ্টির তুমুল উন্মাদনার কাল, স্ফুরিত স্ফুলিঙ্গের চমকে কুসুমি বাহার বিচিত্র বিস্ময়। সেই টগবগে প্রতিভামণ্ডিত কবিদের কাতার কতটা দীর্ঘ ছিল আজ ভাবতে বসলে অবাক হতে হয়! যারা সকলেই ছিলেন আলোচ্য এবং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নব্বই দশকের কবি, লেখকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- শিবলী মোকতাদির, শামীম কবীর, বায়েজীদ মাহবুব, খৈয়াম কাদের, পিয়াল খন্দকার, অমিত রেজা চৌধুরী, আরিফ রেহমান, তৌফিক জহুর, সাজ্জাদ বিপ্লব, সুপান্থ মল্লিক, মতলেবুর রহমান, সেলিম রেজা সেন্টু, আমির খসরু স্বপন, আবদুল খালেক, সাকিল আহমেদ, মান্নান আরজু, হাবীবুল্লাহ জুয়েল, কবীর রানা, সাকিব হাসান, মিতা নূর, মানিক মাহমুদ, জি এম সজল, জে এম রউফ, মাইনুক ফারুক, এস এ রহমান, সাহাব উদ্দিন হিজল প্রমুখ।
দশকের দুন্দুভি বাজিয়ে কালে কালেই উদয় হয়েছেন, হচ্ছেন কবিতার জাতকগণ। বিচিত্র অর্থেই তারা অবচেতনে উদাসীন পাঠকের মনে, মননে, মগজে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাদের আগমন বার্তা। যাপিত জীবনের নিংড়ানো গল্পকেই ধন করে দর্শনাশ্রিত হয়ে তাঁরা লিখছেন। তাতে ধরা পড়ছে নান্দনিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। প্রথাভাঙা- বলাটা যেমন সহজ, করাটা দুষ্কর। আর দুঃসাহসিক কাজে হাত দিয়ে তাঁরা কবিতায় আনতে চাচ্ছেন নতুন মোচড়।
এ সময়ে শূন্য দশকে যারা উজ্জ্বল পদচারণায় মুখর করে তুলেছিলেন সাহিত্যের অঙ্গন তাঁরা হলেন- অনন্ত সুজন, এমরান কবির, মাহমুদ শাওন, মামুন রশীদ, ইসলাম রফিক, তালাশ তালুকদার, সরফরাজ স্বয়ম, প্রান্তিক অরণ্য, ঈশান সামী, সাজ্জাদ সাইফ, অরণ্য প্রভা, ইন্দ্রজিৎ সরকার, আহমেদ জুয়েল, রাহাত রিটু, আবদুর রাজ্জাক বকুল, অচিন্ত্য চয়ন, নাহিদ হাসান রবিন, বিধান সাহা, কামরুজ্জামান মাসুম, লিটন সাহা, শাহন-ই-জেসমিন ডরোথী, আমিনুর রহমান আকাশ, সেলিনা শিউলি, তাসলিমা পারভীন বিউটি, মুহম্মদ আবদুর রশিদ, সায়রা হেলাল প্রমুখ। মফস্বল শব্দটার সঙ্গে ঘোরতর বিরোধ আছে আমার। তবু এ কথা অনিবার্য যে, কেন্দ্র ঢাকায় থাকলে যে সুযোগ-সখ্যতা, ট্যালেন্টের দাম পাওয়াটা যত সহজে হয়, বগুড়া শহরে তা কিছুটা বিরল। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় অভিমানের, অলসতার। নির্লিপ্ত হতে হতে, উদার হতে হতে, ছাড় দিতে দিতে তারা একসময় নিজেদেরই ছারখার করে দেন। গোপনে লেখেন বটে, জিজ্ঞাসিলে বলে- কী হবে এসব করে? হাতে গোনা দু-চারজন ছাড়া বগুড়ার অধিকাংশ কবি-লেখকদের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছিল এবং ঘটছে। মানুষের মানবতা এবং মানবিক মূল্যবোধকে তারা ধারণ করে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধে নিসর্গের প্রতিটি বস্তুর মধ্য দিয়ে ঘোষিত করেছেন তা অকপটে। হতাশা, অস্থিরতা, চিরন্তন প্রেম এবং ক্ষুধাকে পাশাপাশি বিপ্লবের মাত্রায় যুক্ত করেছেন। সঙ্গে প্রকৃতি, নারী এবং নিঃসঙ্গতা। বগুড়ার বিগত পাঁচ দশকের (ষাট থেকে শূন্য) অধিকাংশ কবি-লেখকদের লেখনীর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় নিসর্গের সংলাপ, সীমানাবিহীন অন্ধকারে নির্মম জ্যোতির ব্যাপ্তি কিংবা চৈতন্যের উত্থান-পতন। জন্মভূমির প্রিয় মৃত্তিকার গন্ধ, ধুলো ওড়া প্রান্তর, সবুজ বৃক্ষলতা। যাদের কাছে লেখা মানেই একটি আর্তনাদ, একটি হাহাকার, একটি অন্তর্গত ক্রন্দন ধ্বনি। একটি দহন, একটি অন্তর্নিহিত অথচ বিশাল ব্যাপ্তিময় অগ্নিপথ, দৃপ্ত উচ্চারণ।
[নোট : ক্ষুদ্র পরিসরে এ লেখায় বিস্তারিত ধরা গেল না অনেক কিছুই, মনের অজান্তে অনেকের নাম লিপিবদ্ধ করতে পারলাম না। এ দীনতা আমার। এটা সাচ্চা ইতিহাস নয়। সেটা তৈরিতে তথ্য দিয়ে সাহায্য করুন।]