গল্প
মুখ দেখা যায় না এমন অন্ধকারেও আমি বড় চাচার মুখটি স্পষ্ট দেখতে পাই। কতদিন পর দেখা মনে করতে পারি না। বয়সের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু রাশভারীভাব ও গাম্ভীর্য একটুও কমেনি।
গাড়ি থেকে নামতেই বড় চাচা এসে হাত ধরলেন আমার। মাথায় হাত বুলালেন। এতটা ক্যাজুয়াল হতে তাঁকে কেউ কখনো দেখেছে কি না সন্দেহ। শুধু আমার বেলাতে ব্যতিক্রম। আমি স্থির ও নির্বিকার তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দেখলাম স্বচ্ছ চশমার কাচ ঘোলা হয়ে উঠছে। এ দৃশ্য দেখে আমি বাইরে বাইরে স্বাভাবিক দেখালেও ভিতরে ভিতরে হকচকিয়ে যাচ্ছি। আমার রাশভারী-গম্ভীর চাচার চোখে পানি!
বাড়িতে এসে আমার চোখেও কি পানি এলো! আমার শৈশব, তারুণ্য, যৌবনের শুরু- সবই তো এখানে। আমার নিঃশ্বাস মিশে আছে এখানে। নিমের গাছগুলো কত বড় হয়ে গেছে! বলা যায় তারা এখন পূর্ণ যুবতী। যখন গাছগুলো উঠোনে লাগানো হচ্ছিল, তখন আমাদের যৌথ পরিবারের সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। বাড়ির ভিতরে কেউ নিমগাছ লাগায়? কিন্তু বড় চাচার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনো কেউ কিছু বলবে তা কী করে হয়! বড় চাচাই একসময় বললেন, বাড়িতে নিমগাছ থাকলে অসুখ-বিসুখ কম হয়।
আমার কত যে স্মৃতি ওই নিমবৃক্ষের ছায়াতে! ঝিরিঝিরি পাতার হালকা দোলায় আমার কত আবেগ কত উষ্ণতা! জোসনায় তার কী যে রূপ! এই নিমবৃক্ষের জোসনায় ভিজে ভিজে কত কথা হয়েছে রাতের বিভিন্ন প্রহরের সঙ্গে তার কোনো হিসাব নেই। কে জানত এসব আমি আর নিমবৃক্ষের ওই ঝিরিঝিরি পাতা ছাড়া! আর ডালে বসে থাকা কয়েকজন রাতজাগা পাখি!
বড় চাচা ফোনে বললেন কাকে যেন, ‘হ্যাঁ। এসেছে। আমার কাছে এখন।’ বাবা অথবা মা হবেন। এর চেয়ে বেশি কথা চাচা বলবেন না। কেউ জিজ্ঞেসও করবে না।
দুপুরে খেয়ে একটু শুয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি দরজায় ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ডোনা। বিস্ময়ের ঘোর কাটে না আমার! ডোনা এখানে এলো কীভাবে? কীভাবে জানল আমি এখানে এখন! প্রধান ফটক পার হয়ে এতগুলো দরজা আর স্পেস পার হয়ে নিমবৃক্ষের ছায়া মাড়িয়ে! কীভাবে? কেউ তাকে আটকালো না! নিমবৃক্ষের ফাঁক দিয়ে বিস্তৃত উঠোনে ছড়িয়ে পড়া ঝিরিঝিরি আলো-ছায়ায় সে থমকে দাঁড়াল না একটু! নাকি দাঁড়িয়েছিল!
ডোনা স্থির দৃষ্টি দিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তার অভিমানের দীপ্তি। ক্রমেই সে দীপ্তি রাগে রূপান্তরিত হতে লাগল। তারপর স্পষ্ট ক্রোধ। ফরসা গাল লাল হয়ে উঠল।
আমি উঠে বসে তাকে বলতে চাইলাম, ‘শোনো ডোনা। ইরার বিষয়টা তোমার শোনা দরকার। তাকে নিয়ে যে কথা চাউর হয়েছিল তা মিথ্যে। তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কিংবা সে আদৌ অন্তঃসত্ত্বা ছিল কি না তাও নিশ্চিত নয়।’
ডোনা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এবং রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ানো শুরু করেছে। আমার কথা শুনছেই না। আমিও তার পিছে পিছে দৌড়ানো শুরু করেছি।
বড় উঠোন পেরিয়ে মূল ফটকের দিকে যাওয়া লন ধরে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে ডোনা। আমি তার পিছে পিছে। দৌড়াতে দৌড়াতে নিমবৃক্ষের ছায়ায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছি আমি।
বড় চাচাকে আজ বেশি গম্ভীর মনে হচ্ছে, ‘কোথায় যাও ওদিকে?’
আমি ডোনার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করি। মুখে কিছু বলতে পারি না। বড় চাচা বলেন, ‘কেউ নেই ওদিকে।’
কিন্তু আমি জানি ওদিকে কেউ আছে। ডোনা অথবা ইরা। অথবা অপসৃয়মাণ নিমবৃক্ষের ছায়া।
সন্ধ্যার পর বের হই কর্মযজ্ঞ দেখতে। বিশাল চাতাল আমাদের। অসংখ্য শ্রমিক কাজ করছে। দিনরাত সমান এখন। আমার সঙ্গে নীরাপু। বড় চাচার মেয়ে। বিয়ের বছর না পেরোতেই বিধবা হয়ে যাওয়া নীরাপু কয়েক মাস হলো বাবার বাড়িতে। বড় চাচা চাননি সংক্ষিপ্ততম সংসারের কোনো স্মৃতি তার মেয়ের অন্তরে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধুক।
কোথাও ধান ছড়ানো হচ্ছে, কোথাও শুকানোর জন্য নেড়ে দেওয়া হয়েছে, কোথাও সিদ্ধ হচ্ছে। আমরা হেঁটে হেঁটে এই অপরূপ কর্মযজ্ঞ দেখছি। নীরাপু আমার হাত ধরে ঘনিষ্ঠ হয়ে হাঁটছে আর খলবল খলবল করে কথা বলছে। কিন্তু কোনো কথা আমার কানে ঢুকছে না।
এক মধ্যবয়সি মহিলা আমাকে ইঙ্গিত করে নীরাপুকে নীচুস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘জামাই?’
নীরাপু ডান হাতটা তার বাম হাতের ভিতরে পেঁচিয়ে ধরে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ।’
ফেরার সময় স্তূপ করে রাখা ধানের বস্তার সঙ্গে আমাকে ঠেসে ধরে বুকের ওপর ঝুঁকে এসে নীরাপু বলল, ‘তুই এত কার কথা ভাবিস রে? ইরা না-কি ডোনা?’
শেষের ভঙ্গিটা যেন তাচ্ছিল্যের। ইরার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার গুজব আর ডোনার অভিমান সবকিছু ওলোট-পালোট করে দিয়েছিল। অন্তঃসত্ত্বার অভিযোগ নিয়ে ইরার পরিবারের নিখোঁজ হওয়া আর ডোনার অভিমানী আত্মহত্যা যেন নীরাপুকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
‘বলতো ইমু, ইরার সঙ্গে তোর কি সত্যি সত্যি...।’ কথাটা শেষ করতে দিই না আমি। ভস্মদৃষ্টিতে তাকিয়ে নীরাপুকে বুকের ওপর থেকে ঠেলে তুলে আলো-আঁধারির দিকে হেঁটে যেতে যেতে বলি, ‘নীরাপু, যার যা অধিকার তাকে সেটা দেওয়া উচিত কি-না বলো?’
নীরাপু উদীয়মান চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বলল, ‘কথা ঘোরাচ্ছিস কেন?’
আমি নীরস মুখে বলি, ‘কথা ঘোরালাম কই! যা সত্যি তা বলতে পারব না?’
নীরাপু খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে প্রায় বুক ছুঁয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘অধিকার কেউ কাউকে দেয় না ইমু।’ তারপর আস্তে আস্তে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ‘অধিকার আদায় করে নিতে হয়। বুঝিস না?’
রাতে খেয়ে-দেয়ে ঘরে ঢোকার আগে নীরাপু হঠাৎ দড়ি খেলার মতো করে ওড়না দিয়ে আমার পিঠে লাগিয়ে টান দিয়ে কাছে টেনে নেয়। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাল তাল কোমলতার ভিতরে ডুবে যেতে যেতে শুধু শুনতে পাই, ‘কাল তোর চাচাকে বলবি তোর অধিকারের কথা।’ আমি ওই কোমল সমুদ্রের নির্জন কোলাহল আর সুনামি-সুবাসের অতল গহ্বর থেকে ফিরে আসতে আসতে বলি, ‘ঠিক আছে নীরাপু।’
চাচাকে পরদিন স্পষ্ট করে বললাম, ‘ধানের এই গন্ধটা দুর্গন্ধ লাগছে। সুবাস হয়ে আসছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। কারণ এই ধান পরিপূর্ণরূপে আমাদের নয়। এর ভিতরে অন্যের ধান রয়েছে। যার যে জমি তা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।’
বড় চাচার সামনে এত দীর্ঘ বাক্য কেউ কোনো দিন ব্যয় করেনি। কোনো উত্তরের আশা করিনি আমি। তাঁর সামনে থেকে চলে এসেছি কথাটা বলেই। বাকিটা তাঁর ইচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছেটা কখনো জাগবে কি-না জানি না। এতদিনে যেহেতু জাগেনি। এমনকি অন্যের জমি আমাদের দখলে থাকলেও কখনো ন্যায়-অন্যায়ের গ্লানি তাঁর ভিতরে দেখিনি আমি। সে অনেক কথা। আজ এভাবে বলাতে কাজ না হলে আবারও বলব। আরও দৃঢ়ভাবে।
দুপুরবেলা ভাত ঘুমের সময়ে নীরাপু এলেন। ‘দেখ তো ইমু কেমন লাগছে আমাকে’ শাড়ির আঁচল ওড়াতে ওড়াতে ডানে বামে দুলতে দুলতে বললেন নীরাপু। আমি একবার তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। নীরাপুকে গ্রিক দেবীর মতো লাগছে। তার শরীর থেকে এক মোহনীয় সুবাস ভেসে আসছে। কিন্তু সেটা আমার নাকে লাগলেও হৃদয় স্পর্শ করছে না। আমার নাকে এসে লাগছে ধানের গন্ধ। আমি চেয়েছিলাম ধানের এই গন্ধ সুবাস হয়ে আমার কাছে আসুক। কিন্তু অন্যের ধান থাকলে নিজের ধানে সুবাস থাকে না। গন্ধ থাকে। কখনো কখনো সে গন্ধ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়।
‘ইরা পরলে তো খুব কাব্যি করতি। ডোনা বললে তো তার ভিতরে ডুবে যেতি। যেতি না?’ নীরাপু কৃত্রিম রাগ দেখায়। তারপর বুক ছুঁইছুঁই দূরত্বে এসে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, ‘দেখ, শাড়িটার রং ধানের পাতার মতো। আমার খুব পছন্দ। তোর?’
অসীম নীরবতা খেলা করে ওই ভরদুপুরের রোদের ভিতরে। নিমবৃক্ষের ছায়ার ভিতরে ওই নীরবতা কতটুকু প্রবেশ করে জানি না। কখনো কখনো নীরবতাও কোলাহলের কারণ হয়ে ওঠে। হয়তো উঠোনের নিমবৃক্ষের ছায়ার ভিতরে লিরলিরানি বাতাস বইছে। তার ভিতরে শুরু হয়েছে হেমন্তের কোলাহল।
মনে হলো এই দুপুরের হেমন্তে হালকা বাতাসে কিছু খড় বিচালি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। না হলে কেন নীরাপুর শাড়ির আঁচল আমার নাকে-মুখে হালকাভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবে!
‘সত্যি করে বলবি, ইরার কি হেমন্ত হয়েছিল?’
এই প্রথম আমি নীরাপুর চোখে চোখ রেখে বলি, ‘না। নীরাপু শোনো, হেমন্তের এই ধানগুলো ধান হয়ে ওঠার জন্য ওগুলোর ভিতরে দুধ জমতে হয়। আর দুধ জমার জন্য লাগে ঘোর বর্ষা। আমি যার নাম দিয়েছি প্রণয়-বরষা।’
নীরাপুর উচ্ছলতা কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। চঞ্চল চোখের সুনামি-ঢেউ বন্ধ হয়ে সেখানে এখন গভীর সমুদ্রের গভীরতা।
‘সেই বরষা কি এসেছিল ইমু? আমাকে সত্যি করে বল।’ বলতে বলতে নীরাপু আমার ডান হাতটা তার দুই হাতের ভিতরে টেনে নেয়।
আমি হাত সরিয়ে নিই না একটুও। বাম হাতটা তার হাতযুগলের উপরে রেখে বলি, ‘বরষা আসেনি কখনো নীরাপু। শুধু এসেছিল নিমবৃক্ষের ছায়া।’ তখনই বাইরে চোখ যায়। দেখি হেমন্তের বাতাসে দুলে উঠছে নিমবৃক্ষের ডালপালা। খড়বিচালি উড়ে যাচ্ছে বুঝি! না হলে নীরাপুর আঁচল কেন আমার মুখের ওপর বুকের ওপর বারবার পরশ বুলাচ্ছে!
যাওয়ার সময় নীরাপু একটা বক্স দেন আমাকে। বলেন, ‘নিয়ে যা। আসল ধান। ধানের রং দেখিস। আমার শাড়ির রং তো দেখলি না। দেখলি না শাড়ির উল্টো দিকে থাকা নদীর গোপন মানচিত্র। আর সুবাস মেখে নিস। এই ধান তোর।’
আমি নিঃশব্দে নীরাপুকে দেখতে থাকি। আজ একবারও নীরাপু আমার দিকে তাকাননি। এই প্রথম আমার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন। আমি তাকে অমন করে দেখছি বলে!
‘আসছে বর্ষায় আসবি? ধানে দুধ জমাতে?’
‘আসব নীরাপু। তবে ধান যদি শুধু আমার হয়।’ মনে মনে বলি। নীরাপুকে বলা হয় না।