‘ইটের মিনার, ভেঙেছে ভাঙুক, ভয় কী বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী-চার কোটি পরিবার।’ প্রথম শহীদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম কবিতা লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র, আলাউদ্দিন আল আজাদ। সময়ের পালা বদলে তিনি হয়ে ওঠেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী সব্যসাচী সাহিত্যিক।
জন্ম : ১৯৩২ সালের ৬ মে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রামনগর গ্রামে। বাবা গাজী আব্দুস সোবহান, মা মোসাম্মাৎ আমেনা খাতুন। মাত্র এক বছর বয়সেই মাকে হারিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় হারিয়েছিলেন বাবাকেও। তারপর শুরু হলো তাঁর জীবন সংগ্রাম। এরপর দাদির কাছে বেড়ে ওঠা তাঁর। কিন্তু গ্রামের সংসারে তখন ভীষণ অভাব। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা। মানুষ মারা যাচ্ছে অনাহারে। একবার তাঁর দাদির খুব অসুখ। আর্থিক অনটন ও দুরবস্থায় চিকিৎসক দেখাতে পারলেন না। রচনা প্রতিযোগিতায় যে সোনার মেডেল পেয়েছিলেন সেটাই ভৈরব বাজারে বিক্রি করে বাজার থেকে যখন ডাক্তার নিয়ে বাড়ি ফিরলেন দেখলেন দাদি মারা গেছেন। ড. সফিউদ্দিন আহমদ রচিত ‘সাহিত্যের সব্যসাচী আলাউদ্দিন আল আজাদ’ বইতে এমনই কাহিনি দেখতে পাই। ট্র্যাজেডির এই নায়ক এক সময় হয়ে উঠলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, শিশু সাহিত্য, গবেষণা- যেখানে হাত রেখেছেন ফলিয়েছেন সোনা। কিংবদন্তি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্মজীবন ছিল বহুমাত্রিক ও বর্ণাঢ্য।
রায়পুরেরই স্থানীয় নারায়ণপুর শরাফতউল্লাহ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাস করেছিলেন তিনি। সালটা ১৯৪৭। সে বছরই হলো দেশভাগ। তাঁর ইচ্ছে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হবেন। সেখানেই ভর্তি হলেন কলা বিভাগে। ১৯৪৯ সালে কৃতিত্বপূর্ণ ফল করে জায়গা করে নিয়েছিলেন বোর্ডের মেধাতালিকায়। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে থাকার সময় কলেজের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালে আলাউদ্দিন আল আজাদ ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্যচর্চার সূচনা হয়েছিল ১৩ বছর বয়সে। ১৯৪৬ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রবন্ধ ‘আবেগ’ এবং গল্প ‘জানোয়ার’। তখন তাঁর বয়স ১৪ বছর। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় আলাউদ্দিন আল আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার দিনে বিক্ষোভকারীদের একজন হিসেবে আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রত্যক্ষ করেন একুশের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিনের নির্মম মৃত্যু ও জব্বার, বরকতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য।
একুশের প্রথম বুলেটিন যার শিরোনাম ছিল ‘বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর কবর রচনা করি।’ এখানে ঠাঁই পেয়েছিল আলাউদ্দিন আল আজাদের রচিত ‘স্মৃতি স্তম্ভ’ কবিতাটি।
১৯৫৫ সালে নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। ১৯৫৬ সালে যোগদান করেন জগন্নাথ কলেজে। ১৯৬২ সালে যোগ দেন সিলেট এম সি কলেজে। সেখান থেকে ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৬৯ সালে লন্ডনে যান পিএইচডি করতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন তিনি। দেশে ফিরে ১৯৭৪ সালে ঢাকা কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালে যোগদান করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। পেশাগত জীবনে মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে সংস্কৃতি উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিব, সংস্কৃতিবিষয়ক বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। সাত বছর তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা। বিখ্যাত রয়েল সোসাইটির ফেলো ও যুক্তরাষ্ট্রের মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ সোসাইটির মেম্বার ছিলেন। আলাউদ্দিন আল আজাদের প্রথম উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। প্রথম উপন্যাসেই সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। যে উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে নির্মিত হয়েছিল বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘বসুন্ধরা’। প্রথম প্রবন্ধ সংকলন, প্রথম কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, শিল্পসাহিত্য সমালোচনা, নন্দন তত্ত্ব থেকে গবেষণা, শিশুসাহিত্য, সম্পাদনা, অনুবাদ-সাহিত্যের প্রতিটি ধারায় ছিল আলাউদ্দিন আল আজাদের বিচরণ। আলাউদ্দিন আল আজাদ একাধারে ছিলেন শিক্ষক এবং গবেষক। জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘মণিহার’-এরও পুরোধা ছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতিকে সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
তাঁর সৃষ্টিকর্মের সম্ভার অবিশ্বাস্য। মোট ১১৮টি গল্প, ২৪টি উপন্যাস, ১২টি নাটক, ১১টি কাব্যগ্রন্থ, পাঁচটি প্রবন্ধ সংকলন, ত্রিশের বেশি সংকলিত গ্রন্থ, বিশের অধিক অনূদিত গ্রন্থ এবং অজস্র সাহিত্য সমালোচনা। পঞ্চাশ দশকের প্রথম ভাগ থেকে নব্বইয়ের শেষভাগ পর্যন্ত, টানা ৫০ বছরেরও অধিক সময় ধরে বিস্তৃত ছিল আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্য সাধনা। একাধারে প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী ভাবধারায় সাহিত্যচর্চা। অন্যদিকে গ্রামের মানুষ ও তাদের সংগ্রাম, প্রকৃতির ঐশ্বর্য ও সংহারমূর্তি সাহিত্যে তুলে ধরা কিংবা নগরজীবনের কৃত্রিমতা, রাজনৈতিক সংগ্রাম, নিপীড়ন, প্রতারণা সমস্তই ছিল আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্যের উপজীব্য। আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্যে এসেছে বাংলাদেশ ও পূর্ব বাংলার পটভূমি। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের গণমুখী ও স্বদেশপ্রেমী সাহিত্যধারার সাহিত্যিক। বাংলা এবং বাঙালির জীবনকে উপজীব্য করে সাহিত্যের মূলধারায় এমন বিস্তৃত পরিসর তৈরি করতে পেরেছেন খুব কম সাহিত্যিকই। তাই তো আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হৃদয়ে।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও গবেষক আলাউদ্দিন আল আজাদ ২০০৯ সালের ৩ জুলাই মারা যান।